সকাল গড়িয়ে দুপুর। চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় একটি মোটরসাইকেল শোরুমের পাশে আনমনা হয়ে বসে আছে ৯ বছরের শিশু আব্দুর রহমান। কোলে ঘুমাচ্ছে তার ১৩ মাস বয়সী ছোট ভাই আব্দুল্লাহ। হাতে একটি কাপড়ের ব্যাগ। কিছুক্ষণ পর ভাইকে কোলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল রহমান। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে কথা বলছে সে। পরে জানা গেল, শহরের অলিগলি ঘুরে সাহায্য তুলছে আব্দুর রহমান। 

কিছুদিন আগে মাকে হারানো রহমানের বাবাও অসুস্থ। ফলে বাধ্য হয়ে সংসারের বোঝা তুলে নিতে হয়েছে কাঁধে। বাবা-ভাইয়ের খাবার জোগাতে নামতে হয়েছে পথে। যে বয়সে তার স্কুলে যাওয়ার কথা, সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলা করার কথা, সেই বয়সেই রহমানকে শুরু করতে হয়েছে জীবন সংগ্রাম।

রোববার (১ মে) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চুয়াডাঙ্গা শহরের রেলওয়ে স্টেশনের বস্তির পাশে একটি টিনের বাড়িতে দুটি ঘর নিয়ে ভাড়া থাকে তারা। প্রতি মাসে ৫শ টাকা দিতে হয়। ছোট আব্দুল্লাহ ঘুমিয়ে আছে। বাড়ির উঠানেই রহমান আপনমনে খেলা করছে।

প্রতিবেদককে দেখেই রহমান ও তার বাবা চেয়ার এগিয়ে দেন। এরইমধ্যে ঘুম ভেঙে যায় আব্দুল্লাহর। প্রতিবেশী এক নারী তাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন। কথা হয় আব্দুর রহমান ও তার বাবা আক্তার বিশ্বাসের সাথে।

আব্দুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলে, আমার পঙ্গু মাকে হুইল চেয়ারে ঠেলে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে সাহায্য তুলতাম। সে সময় ছোট ভাই আব্দুল্লাহ মায়ের কোলেই থাকত। সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েই চলছিল। কিডনিজনিত কারণে গত ৪ মাস আগে মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে আমি নিজেই ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে যা পাই তা দিয়েই সংসার চলে।

ছোট ভাইকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে ঘুম পাড়ানো সবই আমি করি। কারণ বাবা তো অসুস্থ। এ ছাড়া ঘরের সমস্ত কাজ, বাবার গোসলের পানি তুলে দেওয়া সবই করতে হয়। তবে এসব আমার ভালো লাগে না। আমি পড়াশোনা করতে চাই। আর কেউ যদি একটা বাড়ি করে দিত তাহলে আমাদের খুব ভালো হতো। 

রহমান আরও বলে, মা থাকলে ঈদের আমেজ থাকত। সেটা এখন নেই। এবার ঈদে আমি পোশাকসহ বাজার পেয়েছি, শুধু আমার মাকে পাইনি। মা নেই বলে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মা থাকলে সবাই ভালো মতো ঈদ করতে পারে।

প্রতিবেশীরা বলেন, অনেক কষ্ট করে আব্দুর রহমান তার ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে সাহায্য তুলে সংসার চালায়। তবে তাদের কষ্ট দেখতে আর ভালো লাগে না। আমরাও নিজেদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করি। সাহায্য তুলে ঘর ভাড়া দিই। সরকারের কাছে আবেদন, তাদের যেন একটা ঘর উপহার দেওয়া হয়।

বাড়ির মালিক নুরুল ইসলামের স্ত্রী বলেন, বাড়ি ভাড়ার জন্য আমরা চাপ দিই না। যা পারে তাই দেয়। বেশ কিছুদিন যাবত আমাদের এখানেই আছে। আব্দুর রহমান সাহায্য তুলে যা পাই তা দিয়েই চলে সংসার। মা ছাড়া ঈদ করবে এবার। আমার কাছে খুব খারাপ লাগছে। সরকার যদি তাদের একটা বাড়ি করে দেয় তাহলে তাদের কিছুটা দুঃখ লাঘব হবে।

তিনি আরও বলেন, রহমানের বাবা অসুস্থ। ছোট ভাই আব্দুল্লাহকে নিয়ে বাইরে বাইরে থাকে। আব্দুল্লাহকে দেখার জন্য একজন মায়ের প্রয়োজন। তাই কয়েকদিন আগে এলাকার এক নারীর সাথে তার বাবার বিয়ে দিয়েছি। যেন তাদের দেখাশোনা করতে পারে। 

আব্দুর রহমানের বাবা আক্তার বিশ্বাস বলেন, সৎ মায়ের জন্য আমি পরিবার ছেড়েছি। বছর খানেক আগে ফেরি করে বাদাম বিক্রির সময় ট্রাকের ধাক্কায় আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করি। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। কোনোভাবে চলাফেরা করতে পারি। রহমান সাহায্য তুলে যা পায় তা দিয়েই সংসার চলে। বিভিন্ন সময় জেলা-উপজেলা প্রশাসন কিছুটা সহযোগিতা করেছে। তা দিয়ে চিকিৎসা করেছি। এই ঈদে দুই সন্তানের জামা-কাপড় দিয়েছে অনেকে। সরকারের নিকট আবেদন, আমাকে যেন একটা ঘর করে দেয়। তাহলে হয়তো কিছুটা কষ্ট কমবে। 

জানা গেছে, সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের বলাডাঙ্গা গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে আম্বিয়া খাতুনের ১৩ বছর আগে বিয়ে হয় যশোর মণিরামপুরের বাদাম বিক্রেতা আক্তার বিশ্বাসের সঙ্গে। কিন্তু এখানে এসেও পিছু ছাড়েনি দরিদ্রতা। আম্বিয়ার স্বপ্ন ছিল স্বামীকে নিয়ে ছোট্ট একটি সংসার করবেন। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে গড়ে তুলবেন সুখের সংসার।

পরে কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে সাতক্ষীরা থেকে আম্বিয়া খাতুন স্বামী আক্তার বিশ্বাসের হাত ধরে চলে আসেন যশোর শহরে। থাকতেন একটি বস্তিতে। স্বামীর বাদাম বিক্রির টাকা দিয়ে কোনোমতে চলত তাদের সংসার। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আম্বিয়ার কোলজুড়ে আসে আবদুর রহমান। স্বামীর স্বল্প আয় থেকে কিছু টাকা জমাতে থাকেন আম্বিয়া।

২০১৮ সালে খুলনার শিরোমণির গিলাতলা মোহাম্মদীয়া হাফেজিয়া মাদরাসায় ভর্তি করান ছেলে রহমানকে। ২০১৯ সালের মার্চে সারাদেশে করোনা ছড়িয়ে পড়লে আবদুর রহমানকে মাদরাসা চলে আসতে বলে কর্তৃপক্ষ। আবদুর রহমান হাফেজিয়া পড়ার পাশাপাশি ওই মাদরাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করত।

অভাব যখন নিত্যসঙ্গী ঠিক তখনই আম্বিয়ার গর্ভে আসে নতুন সন্তান। এমনিতেই করোনার ভয়াবহতার মধ্যে সংসার চলে না, তার ওপর আরেক অতিথি। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে প্রসব বেদনা উঠলে স্ত্রীর মরণাপন্ন অবস্থা দেখা দেয়। পরে যে সম্বল ছিল, তা নিয়ে আক্তার বিশ্বাস আম্বিয়াকে ভর্তি করান হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

চিকিৎসরা জানান, এক্লাম্পসিয়ায় আক্রন্ত হয়ে আম্বিয়ার শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশ অসাড় হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি চোখ। অনেক কষ্ট করে আবদুল্লাহ পৃথিবীর আলোর মুখ দেখলেও আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান আম্বিয়া। সন্তান প্রসবের বেদনা কমতে না কমতে আরেকটি দুঃসংবাদে যেন আম্বিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

আম্বিয়ার যেন দুঃখের শেষ নেই। যার কাঁধে ভর করে সব দুঃখ নিয়ে জীবন পাড়ি দেবেন, ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে সেই স্বামীকে আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ এলাকায় একটি ট্রাক পেছন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। পরে পথচারীরা উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। তবে টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা না পেয়ে তিনিও পঙ্গুত্ব বরণ করেন। তাই বাধ্য হয়ে আম্বিয়া ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে হুইল চেয়ারে বসে শহরের বিভিন্ন স্থানে মানুষের কাছে সাহায্য চায়তেন। আর হুইল চেয়ার ঠেলত আবদুর রহমান। এভাবেই চলছিল তাদের সংসার। 

কিডনির সমস্যা এবং জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ফার্মপাড়ার ভাড়া বাড়িতে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান মা আম্বিয়া খাতুন। এরপর শুরু হয় আব্দুর রহমানের জীবনযুদ্ধ।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীম ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। তাদেরকে যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে আমার অফিসে আসতে বলা হয়েছিল। পরে আর আসেনি। তারা আসলে আমি তাদেরকে সরকারিভাবে বাড়ি করে দিব। এ ছাড়া বাচ্চাটির বাবা চাইলে দোকানও করে দেওয়া হবে।  

আরআই