বিয়ের কয়েক বছর পর কোলজুড়ে আসে দুই কন্যাসন্তান। দুই মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার গড়ার স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। সংসারে নেমে আসে অশান্তি। স্বামী হয়ে পড়েন নেশাগ্রস্ত। শুরু হয় যৌতুকের দাবি, তারপর নির্যাতন।

অবশেষে দুই মেয়েকে নিয়ে স্বামীর ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। জীবন হয়ে ওঠে অনিশ্চিত। তবু দমে যাননি। দুই মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় রোজিনা খাতুনের সংগ্রামী জীবন। খেয়ে না খেয়ে দরজির কাজ শুরু করেন। তারপর আর মনে নেই পেছনের গল্প। আজ সেই সন্তানদের সুশিক্ষিত করেছেন। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ের লেখাপড়ার করাচ্ছেন।

এমনই এক সংগ্রামী মা চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার নুরনগর কলোনীপাড়ার বাসিন্দা রোজিনা খাতুন। তিনি ওই এলাকার বাইসাইকেলের কারিগর (মিস্ত্রি) ঈমান আলীর মেয়ে।

রোজিনার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে পৌর এলাকার বেলগাছি গ্রামের মিয়াপাড়ার মৃত নুরুল ইসলামের ছেলের সঙ্গে পারিবারিকভাবে তার বিয়ে হয় রোজিনার। চার বছরের ব্যবধানে তাদের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে দুই কন্যাসন্তান। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে অশান্তির কারণে ২০১৬ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।

সরেজমিনে দেখা যায়, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ঈদগা মোড়ের অদূরে একটি ছোট্ট দোকান। দোকানের নাম দেওয়া হয়েছে 'রোজিনা টেইলার্স'। দোকানের ভেতরে ঢুকে দেখা যায় রোজিনা খাতুন সেলাইয়ের কাজ করছেন। তার মাথার ওপর রোজিনা খাতুনের একটি ছবি বড় করে প্রিন্ট করে দেয়ালে টানিয়ে রেখেছেন। দোকানে সেলাইয়ের পাশাপাশি করছেন ছিট কাপড় বিক্রি।

রোজিনা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিয়ের কয়েক বছর পর স্বামীর আচরণে পরিবর্তন লক্ষ করি। দেখি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নেশার টাকা ও যৌতুকের দাবিতে আমার ওপর চলত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। আমি বাবার বাড়িতে চলে যাই। পরে তিনি আমার সুখের কথা চিন্তা করে কিছু টাকা দিয়ে আবার শ্বশুরবাড়িতে পাঠান। কিছুদিন চুপ থাকার পর আবার শুরু হয় নির্যাতন। এবার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মীমাংসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটে।

তিনি আরও বলেন, বিচ্ছেদের পর বাবার বাড়িতে ঠাঁই হলেও তারা আমাকে বোঝা ভাবতেন। কারণ, বাবা বাইসাইকেলের কাজ করে কোনো রকম সংসার চালাতেন। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। দুই মেয়েকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটতে থাকে। ইচ্ছা থাকলেও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দ্বিতীয়বার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি।

মাস তিনেক পর চুয়াডাঙ্গা শহরের রেলবাজারে একটি টেইলার্সে (দরজি দোকান) কাজ শুরু করি। এর মাঝে সুদের ওপর দুই হাজার টাকা নিয়ে বড় মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাই। কিছুদিন কাজ করে অভিজ্ঞতা হলে নিজেই একটি দোকান দেওয়ার কথা চিন্তা করি। কিন্তু জামানত দরকার ২০ হাজার টাকা। পরে চুয়াডাঙ্গা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ শেষে ঋণ নিয়ে দোকান চালু করি। এরপর আর পেছনে ফিরতে হয়নি আমাকে।

কারোর সহযোগিতা ছাড়া এ পর্যন্ত আশা, এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি দিনভর পরিশ্রম করেছি। আট মাস আগে বড় মেয়ে সানরিভা আক্তার শাপলাকে (১৮) ভালো পাত্র পাওয়ায় বিয়ে দিয়েছি। মেয়েজামাই এখন তাকে পড়াশোনা করাচ্ছে। আর ছোট মেয়ে চুয়াডাঙ্গা ঝিনুক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। আমাকে কেউ সহযোগিতা করেনি। নিজে উপার্জন করে খেয়ে না খেয়ে দুই মেয়েকে মানুষ করেছি।

বিধবা নারীরা সমাজে মর্যাদাগতভাবে প্রচুর বৈষম্য ও উৎপীড়নের শিকার। তারা বিভিন্ন কুসংস্কারের জালে আবদ্ধ ও অযৌক্তিক প্রথাগত বাধার সম্মুখীন। এই বাধার কারণে তারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে পারেন না।

রোজিনাও তেমন শিকার জানিয়ে বলেন, ঠিক আমারও বিচ্ছেদের পর লোকজন ও পাড়াপড়শি আমাকে বাঁকা চোখে দেখত। বিভিন্ন সময় খারাপ মন্তব্য করত। মন খারাপ হলেও কখনো প্রতিবাদ করিনি। দুই মেয়ের কথা ভেবে দ্বিতীয় সংসার নিয়ে ভাবিনি। নিজেকে সামনে এগিয়ে নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করেছি। একজন স্বামী-পরিত্যক্ত নারীই জানে জীবনসংগ্রাম কাকে বলে। আজ সব বাধা অতিক্রম করে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে টিকে আছি, এটাই আমার আনন্দ।

প্রতিবেশী উদ্যোক্তা লিলি খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বামীর নির্যাতনে ঘর ছেড়েছেন রোজিনা। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিয়ে করেননি আর। আমাদের চোখের সামনে দরজির কাজ করে অনেক কষ্ট করে দুই মেয়েকে লেখাপড়া করিয়েছেন। আমরা সব সময় তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছি। তিনি একজন সফল মা ও নারী।

চুয়াডাঙ্গা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অ.দ.) মাকসুরা জান্নাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, অসহায় নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকার বিভিন্নভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আমরা তাদের সব সময় সহযোগিতা করে থাকি। রোজিনা খাতুনকেও আমরা সেই সহযোগিতা করেছি। আজ তিনি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন, স্বাবলম্বী হয়েছেন। এমন নারীদের পাশে আমরা সব সময় থাকব।

এনএ