সাবেক শিক্ষক মো. গোলাম মোস্তফা

প্রাথমিকে ছোট ছোট শিশুদের বর্ণপরিচয় ও মানবিক শিক্ষা দিয়েছিলেন। তার হাতে গড়া অনেক শিক্ষার্থী আজ উচ্চশিক্ষা শেষ করে এখন দেশের সেবা ও মানুষের সেবা করছেন। কেউ কেউ পালন করছেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মো. গোলাম মোস্তফা। ৩৫ বছর ধরে নিযুক্ত ছিলেন শিক্ষকতার মতো মহান পেশায়।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠরই ইউনিয়নের গোলেরগাঁওয়ের বাসিন্দা মো. গোলাম মোস্তফা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন।

গোলাম মোস্তফা প্রথম শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৮২ সালের ২৪ জানুয়ারি ছাতক উপজেলার কালারুখা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দুই বছর শিক্ষকতা করেছেন এই বিদ্যালয়ে। এরপর বদলি হয়ে যান একই উপজেলার বাগবাড়ি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৮৮ সালে প্রমোশন পেয়ে কালারুখা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৯৩ সালে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার শাখাইতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এক বছর পরেই একই উপজেলা গোলেরগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবারও বদলি হন। এই স্কুলে প্রায় ২৩ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। গুণী এই শিক্ষক ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ মাসে মহান শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরে যান।

তার সঙ্গে কথা হয় বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আর ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক নিয়ে। প্রাথমিকে একজন শিক্ষার্থীকে গড়ার সময় বলে উল্লেখ করে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সমাজে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় বেড়েই চলছে। শিক্ষায় মানবিক মূল্যবোধ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের জন্য ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক অবনতির দিকে যাচ্ছে। আমি ৩০০ টাকা বেতন স্কেলে শিক্ষকতা শুরু করেছি। তবু কোনো দিন বাণিজ্যিক চিন্তায় ছাত্রদের পড়াইনি।

শিক্ষক মো. গোলাম মোস্তফা

এখন আর আগের মতো নীতিনৈতিকতা এখন নেই মনে করে তিনি বলেন, এখন শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষক ও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। কিন্তু আমাদের সময়ের চিত্র ছিল অন্য রকম। আগে আমরা কোনো শিক্ষার্থীর বাড়িতে গেলে পাশের বাড়ির শিক্ষার্থীও টেবিলে বই নিয়ে পড়তে বসেছে। অথচ তখন পড়ার সময় নয়। আমরা যেভাবে শিক্ষাদান করেছি, সেভাবে আমাদের ছাত্ররা সমীহ করেছে, মান্য করেছে। কিন্তু এখন আমরা দেখি কোনো শিক্ষার্থী এভাবে শিক্ষককে শ্রদ্ধা করে না।

‘স্কুল কোনো দোকান নয়, শিক্ষাও কোনো পণ্য নয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের সময় ছাড়া অতিরিক্ত কেউ পড়াতে চায় না। পড়ালেও অতিরিক্ত টাকা নেন। নিজে কোচিং সেন্টার খুলেছেন। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় দেখি শিক্ষকের কোচিং সেন্টারে না পড়লে পরীক্ষার খাতায় নম্বর মেলে না।

কাগজে-কলমে শিক্ষকতা ছাড়লেও পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে এই শিক্ষক বলেন, আমাদের সময়টা এমন ছিল যে শিক্ষার্থীর কাছে একজন শিক্ষক সর্বোচ্চ সম্মানিত পূজনীয় ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন। শিক্ষকের কাছেও শিক্ষার্থীরা নিজের সন্তানের মতো ছিল। আমরা নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলেছি। এ জন্য এখন নিজেকে সেই শিক্ষার্থীদের আলোকিত জীবনের গর্বিত অংশীদার হিসেবে মনে করি। শিক্ষার্থীরাও তাদের শিক্ষাজীবনে প্রতিটি সাফল্য-ব্যর্থতায় আমাদের স্মরণ করে।

বেশির ভাগ সময় আমি গ্রামেই ছিলাম। কারণ, আমার বদলি করা স্কুলগুলোই ছিল গ্রামে। তবে গ্রামে থাকলেও আমার একটি রুটিন ছিল। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা কমপক্ষে ১০ জন শিক্ষার্থীর বাসায় যেতাম। গিয়ে তাদের পড়াশোনার খোঁজ নিতাম। শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ লক্ষ করতাম। কোনো ত্রুটি দেখলে ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষার্থীদের বোঝাতাম।

মো. গোলাম মোস্তফা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

আগে যেমন অর্থের বিনিময়ে শিক্ষাদান না করে মানুষ গড়ার জন্য মনোনিবেশ করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়েছে, সেভাবে বর্তমানের শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের পড়াবেন। শিক্ষকদের চিন্তা বাণিজ্যিক না হয়ে দেশের সুনাগরিক মানুষ গড়ার চিন্তা থেকে পাঠদান করলে সমাজ এগিয়ে যাবে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বলে এই শিক্ষক মনে করেন।

গোলের গাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবেদ আলী কিছুদিন সহকর্মী হিসেবে পেয়েছেন গোলাম মোস্তফাকে। তিনি সেই সময়কার স্মৃতিচারণা করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুব অল্প সময়ে গোলাম মোস্তফা স্যারকে আমি স্কুলে পেয়েছি। স্যারের ব্যবহার খুবই অমায়িক ছিল। কখনো আমাদের মন খারাপ হলে তিনি মন ভালো করে দিয়েছেন। এটা ছিল তার বিশেষ গুণ। শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমাদেরও হাসিখুশি রাখতেন। নিজেও সব সময় হাসিখুশি থেকেছেন। শুধু শিক্ষার্থী নয়, আমরাও গোলাম মোস্তফা স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।

শিক্ষাকে কোচিং সেন্টার নামক মোড়কে বাজারজাতকরণের জন্য সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। আমাদের এই নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে, এমনটাই মনে করেন সবার প্রিয় শিক্ষক মো. গোলাম মোস্তফা।


এনএ