মরণোত্তর একুশে পদক পাবেন কি গোলাম মোস্তফা রতন
ভাষাসৈনিক গোলাম মোস্তফা
১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া হয়ে পড়েছিল বাংলার আপামর ছাত্র-জনতা। একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ১৯৫২-এর ২১ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে গেলে কার্জন হলের সামনে পুলিশ গুলি চালায়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন গোলাম মোস্তফা।
১৯৪২ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে কারাভোগ, ১৯৪৮ সাল থেকেই মায়ের ভাষা বাংলাকে গ্রাস করার অপচেষ্টা প্রতিহত করার প্রতিবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ভাষাসৈনিক গোলাম মোস্তফা রতন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দুই শতাধিক ছাত্রকে নিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল করে আহত হলেও ৬৯ বছরেও তাকে দেওয়া হয়নি কোনো স্বীকৃতি।
বিজ্ঞাপন
আটবার একুশে পদক পাওয়ার আবেদন করলেও সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও গোলাম মোস্তফা ভেবেছিলেন এবার পদক পাবেন, কিন্তু ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই একবুক হতাশা নিয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন তিনি। দেখে যেতে পারেননি নিজেকে সম্মানের আসনে। এ নিয়ে তার পরিবারসহ মাদারীপুরবাসীর মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে সবার মধ্যে।
স্বভাবতই রতন ছিলেন একজন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় অংশ নেওয়ার জন্য কয়েকটি জেলার ছাত্রদের নিয়ে একটি তালিকা করা হয়। ১৯৫২ সালে তৎকালীন বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র গোলাম মোস্তফা রতন আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এদিকে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছিল বাংলার আপামর জনতা। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছিল বাংলর ছাত্র সমাজ। একই সঙ্গে আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও বরিশালে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রতনের নেতৃত্বে দুই শতাধিক ছাত্র নিয়ে আন্দোলনে অংশ নিতে মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকতেই কার্জন হলের সামনে পুলিশের মুহুর্মুহু গুলি শুরু হয়।
বিজ্ঞাপন
এ সময় মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্ররা মাটিতে শুয়ে জীবন রক্ষা করেন। কিন্তু সালাম, বরকত, রফিকসহ অনেকেই শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান রতন। তারপর শুরু হয় পারিবারিক জীবনযুদ্ধ। কিন্তু দেশের প্রয়োজনে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শিবচর অঞ্চলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ভাষাসংগ্রামী রতন। জাতীয় স্বীকৃতি না পেলেও ২০১২ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এইম ওয়ে) তাকে সম্মাননা পদকে ভূষিত করে। তিনি মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের চররামরায়ের কান্দি গ্রামের নিজ বাড়িতে ১৪ বছর ধরে অসুস্থ অবস্থায় গত ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
ভাষাসৈনিক গোলাম মোস্তফার স্ত্রী লাইজু মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৪২ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে কারাভোগ করেন আমার স্বামী। সে কথা গর্ভের সাথে আমার ও আমার পরিবারের কাছে জানাত। সে সময় আন্দোলনের বিভিন্ন কাগজপত্র দিতে গিয়ে আটক হয় চট্টগ্রামে। সেখানে ১৫-১৮ দিন আটক ছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের নিয়ে ঢাকা গিয়েছিলেন। সেখানে অনেকেই শহীদ হন। তার পায়েও গুলি লাগে। পরে তিনি আমাদের দেশের বাড়িতে চলে আসেন। এরপর জীবনের অনেক সময় চলে গেলেও তাকে দেওয়া হয়নি সরকারি কোনো স্বীকৃতি। আমি দেশবাসী আমার স্বামীকে নিয়ে গর্ব করি কিন্তু সরকার কেন তার ব্যাপারে উদাসীন?
ভাষাসৈনিকের ছেলে মো. মিজান বলেন, আমার বাবা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সৈনিক এবং ভাষা আন্দোলনের একজন নেতৃত্বদানকারী সংগঠক। গত দেড় বছর হলো তিনি মারা গেছেন। এর আগে আমি আটবার একুশে পদকের জন্য আবেদন করেছি সরকারের কাছে।
আমি স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় সবকার তাকে কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। এ জন্য আমি ও আমার পরিবারের দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তবে আমি আশা করব, তার জীবদ্দশায় তিনি সম্মান না পেলেও সরকার আমার বাবাকে দেশের জন্য অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে, তা যেন আমরা তার সন্তান হিসেবে দেখতে পারি।
মো. মিজান, ভাষাসৈনিকের সন্তান
ভাষাসৈনিকের নাতি লাকু বলেন, আমার নানা একজন ভাষাসৈনিক। বরিশাল থেকে ঢাকা শহরে গিয়ে রাজপথে আন্দোলন করেছিলেন। অথচ তার কোনো স্বীকৃতি আমরা আজও দেখতে পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের একটাই দাবি, আমার নানা গালাম মোস্তফা রতনকে যেন সরকার একুশে পদক স্বীকৃতি দেয়, এটাই আমাদের চাওয়া।
এ ব্যাপারে স্থানীয় এলাকাবাসী বলেন, তিনি অত্যন্ত সৎ ব্যক্তি ছিলেন। রাজনীতির মাধ্যমেই জীবন পার করেছেন। তৎকালীন তিনি কোনো চাকরি করেননি। কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি। দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করবেন, এটাই ছিল তার নেশা। আমরা তখন ছোট, তাকে দেখেছি ভাষা আন্দোলন করতে এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দলন করতে। কিন্তু তিনি দেশের জন্য অবদান রেখেও সরকারের কাছ থেকে যথাযথ মূল্যায়ন পাননি। আমার এলাকাবাসী চাই সরকার যেন তাকে মরণোত্তর স্বীকৃতি দেন।
রতনের এক বয়োবৃদ্ধ সহপাঠী বলেন, সে তো মারা গেছে। এখন তার মৃত্যুর পরও যদি কোনো সম্মান পায়, তাতেই আমরা খুশি হব।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদারীপুর জেলায় গোলাম মোস্তফা রতন নামে একজন ভাষাসৈনিক আছেন। এ জন্য আমরা গর্বিত। আমার গোলাম মোস্তফা রতনকে মরোণত্তর একুশে পদক পাওয়ার জন্য তার সব প্রমাণপত্রসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাব।
নাজমুল মোড়ল/এনএ