প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কল্যাণে গড়ে তোলা হয়েছে নার্সারি। ডিজেবল পিপল’স অর্গানাইজেশন টু ডেভলপমেন্ট (এমডিপিওডি) নামের একটি বেসরকারি প্রতিবন্ধী সংগঠন এ নার্সারিটি গড়ে তুলেছে। নার্সারি থেকে আয় করা টাকা প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় করে সংস্থাটি। এমনই একটি নার্সারি গড়ে উঠেছে মানিকগঞ্জ শহরে।

একদিকে সমাজের এসব প্রতিবন্ধীর কল্যাণে গাছের চারা কেনার মাধ্যমে সহযোগিতা করতে পারায় অনেক উৎফুল্ল ক্রেতারা। অন্যদিকে সুযোগ পেয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রচেষ্টায় নার্সারিতে কাজ করে যাচ্ছেন ১১ জন প্রতিবন্ধী কর্মচারী।

ডিজেবল পিপল’স অর্গানাইজেশন টু ডেভলপমেন্টের তথ্যমতে, প্রতিবন্ধীদের আয়বর্ধন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০০৭ সালে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ‘ল’ কলেজ-সংলগ্ন এলাকায় ৫০ শতাংশ এবং বেউথা এলাকায় ১২০ শতাংশ জায়গা ইজারা নিয়ে গড়ে তোলা হয় দুটি নার্সারি। ‘ল’ কলেজ-সংলগ্ন নার্সারিটি বিক্রয় কেন্দ্র আর বেউথা এলাকার নার্সারিটি চারা গাছ উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ দুটি নার্সারিতে প্রায় আড়াই লাখ চারা গাছ আর বিভিন্ন প্রজাতির ৪৫০ চারা গাছ রয়েছে।

তারা আরও জানায়, দুটি নার্সারির জায়গা ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে দিতে হয় ২১ হাজার টাকা। আর প্রতি মাসে গড়ে খরচ হয় দুই লাখ টাকা। চারা গাছ বিক্রি হয় তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকার। নার্সারি দুটিতে তিন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বেতন বাবদ ৩৯ হাজার টাকা আর অফিসের পাঁচ প্রতিবন্ধী স্টাফের বেতন মাসে দিতে হয় ৮০ হাজার টাকা।

নার্সারিতে চারা কিনতে এসেছেন ক্রেতারা

সরেজমিনে নার্সারিতে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রজাতির গাছে ছেয়ে আছে নার্সারি। এর মধ্যে ফলদ গাছ : আম, জাম, পেঁয়ারা, জলপাই, মালটা, কমলা, ডালিম, আনার, রামভুটান, ডরিয়ান, এবোকাঠো, তেঁতুল, আঙুর, মালবেরি, ব্ল্যাকবেরি, গাব, জামান ইত্যাদি। বনজ : মেহেগনি, একাশিয়া, নিম, চাম্বুল, কড়ই, সেগুন, গর্জন, কাঠবাদাম ইত্যাদি। ঔষধি : তুলসী, আমলকী, হরতকী, বহেরা, অর্জুন, লেবু, বিসল্লোকরি, তুরুকচন্ডাল, লজ্জাবতি, হিতকুমারী (এলোভেরা), শতমূল, বিশজারুল ইত্যাদি। ফুল গাছ : টগর, গোলাপ, গাঁদা, বেলি, কাঠবেলি, মিনিটগর, কাঠগোলাপ, রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা, কামিনী, রংগোন, ভারবেলা, কেলোন্ডলা, ডাইন্টাজ, পুর্তলিকা, নাইন-ওক্লক ইত্যাদি।

নিজের বাসা বা বাড়িতে লাগাতে চারা গাছ কেনার জন্য নার্সারিতে এসেছেন কয়েকজন ক্রেতা। তারা নার্সারি ঘুরে ঘুরে দেখছেন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। পছন্দ হলেই কিনে নিচ্ছেন অনেকে। নার্সারির কর্মচারীরা চারা গাছ পরিচর্যা আর বাছাইয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।

নার্সারিতে গাছ কিনতে আসা মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সুকান্ত পাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সময় পেলে মাঝেমধ্যেই ফুল গাছ কেনার জন্য এই নার্সারিতে আসি। এখানকার গাছের মান অনেক ভালো। আমি যে কয়েকটা গাছ নিয়েছি, সবই ভালো। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এখান থেকে যে আয়টা হয়, তা প্রতিবন্ধীদের কল্যাণের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। আমার মনে হয় এখান থেকে সবাই যদি গাছ কিনি, তাহলে এটা প্রতিবন্ধীদের জন্য কল্যাণকর হবে। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে নিজেকে অংশীদার করতেই আমি এখানে আসি।

টবে সাজানো সারি সারি চারা 

মেয়েকে নিয়ে ফুল গাছ কিনতে আসা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড সাভার শাখার সিনিয়র পিন্সিপাল অফিসার উম্মে সালমা শুরভী বলেন, মানিকগঞ্জের মধ্যে এই নার্সারিটা সবচেয়ে বড়। আমার কাছে নার্সারিটা ভালো লাগে। নার্সারিতে বিভিন্ন প্রজাতির চারা গাছ সারিবদ্ধভাবে সাজানো, যা দেখতেও অনেক সুন্দর লাগে। মেয়েকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই ঘুরতে আসি আবার পছন্দ হলে গাছও কিনি।

সালমা আরও বলেন, এই নার্সারির আয়ের একটা অংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্যয় হয়। বিষয়টি জানি বলেই এই নার্সারি থেকে বেশি গাছ কেনা হয়। একদিকে চারাগাছ কেনার মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের সহযোগিতা করতে পারছি, অন্যদিকে গাছের সান্নিধ্যে থাকতেও ভালো লাগে। তাই সবাই যেন বেশি বেশি গাছ কেনেন, এমন পরামর্শ তার।

কামাল হোসেন নামের আরেক ক্রেতা জানান, নার্সারি থেকে চারটি চারাগাছ কিনেছেন তিনি। এর মধ্যে তিনটি গাঁদা ফুল, একটি গোলাপ ফুলের গাছ। বাসার বারান্দায় টপে করে এসব ফুলে গাছ সাজিয়ে রাখার জন্য মাঝেমধ্যে গাছ কেনেন তিনি। এখানকার গাছ খুবই সুন্দর, গুণগত মান অনেক ভালো। এ নার্সারিটি প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করে। নার্সারির লাভের একটি অংশ প্রতিবন্ধীর জন্য উৎসর্গ করে নার্সারি কর্তৃপক্ষ। মূলত এ কারণে এখান থেকে প্রতিনিয়তই গাছ কিনি।

সব ধরনের চারা পাওয়া যায় এখানে

গাছ কিনতে আসা ব্যাংকার আব্দুস সালাম বলেন, বাসার জন্য এখান থেকে গোলাপ, ডালিয়া, রজনীগন্ধা, গাঁদা ফুলসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছের কিনেছি। সব সময়ই এই নার্সারি থেকে গাছ কেনা হয়। বাসায় বাগান করেছি। নার্সারির লাভের কিছু অংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্যয় করে কর্তৃপক্ষ। এতে একদিকে সংগঠনের লাভ হচ্ছে, অন্যদিকে লাভের কিছু অংশ সমাজের প্রতিবন্ধীরাও পাচ্ছে। বিষয়টি আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে।

নার্সারিতে কর্মরত শারীরিক প্রতিবন্ধী কাজী আবদুল আজিজ ঢাকা পোস্টকে জানান, একটি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পা হারিয়ে পরিবারের বোঝা হয়ে ছিলেন তিনি। পরে ২০১১ সালে এমডিপিওডিতে সদস্য হন তিনি। তারপর থেকে ৯ বছর ধরে এই নার্সারিতে চাকরি করছেন। নার্সারির বেতন দিয়ে পরিবার নিয়ে কোনোমতে জীবন যাপন করছেন। তবে এখন তিনি আত্মনির্ভরশীল।

শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. বাবুল হোসেন বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে অন্য কোনো কাজ করতে পারি না। অনেক কষ্ট করে একটি মুদি দোকান দিয়েছি। আমি এমডিপিওডির সদস্য হওয়ায় নার্সারি থেকে কিছু সহযোগিতা পাই।

চারা ‍কিনছেন ক্রেতারা

শারীরিক প্রতিবন্ধী চুমকী হালদার বলেন, আমাদের মতন লোক তো মনে করেন কোনো কাজেই লাগে না। বলতে গেলে অবহেলিত। দরজির কাজ করে কোনোমতে চলতাছি। তবে করোনার কারণে আগের মতো কাজকাম নাই। এমডিপিওডি থেকে পাঁচ হাজার টাকা সহযোগিতা করছে। সেই টাকা দিয়া কিছু উন্নয়ন করার ইচ্ছা আছে। নার্সারি থেকে যে আয়টা হয়, সে আয় থেকে কিছু অংশ আমাদের সহযোগিতা করে।

মানিকগঞ্জ ডিজেবল পিপল’স টু ডেভেলপমেন্ট (এমডিপিওডি) পরিচালক মো. এন্তাজ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা এবং তাদের অন্যান্য চাহিদ পূরণ করার সক্ষমতা সৃষ্টি করার জন্যই মূলত এই নার্সারি করা হয়। শহরের ‘ল’ কলেজ-সংলগ্ন এলাকায় ৬০ শতাংশ এবং বেউথা এলাকায় ১২০ ডিসিমেল জায়গা চারা উৎপাদন কেন্দ্র করা হয়েছে।

এন্তাজ আলী বলেন, নার্সারির আয় থেকে সংগঠনের প্রতিবন্ধী সদস্যদের বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করা হয়। তবে আমরা একজন প্রতিবন্ধীকে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য যা করণীয়, সেটাই করতে চাই। প্রতিবন্ধী শিশুদের বার্ষিক লেখাপড়ার উপকরণ, তাদের প্রাথমিক পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করা হয় এখানে। তিনজন প্রতিবন্ধী সরাসরি নার্সারির ওপর নির্ভরশীল এবং আটজন প্রতিবন্ধী স্টাফের সংসার পরিচালনা করছেন নার্সারিতে কাজ করার মাধ্যমে।

একসময় অনেক প্রতিবন্ধী পরিবারের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এই নার্সারিতে কাজের সুযোগ পাওয়া এখন পরিবারগুলো এই প্রতিবন্ধীতে ওপর নির্ভরশীল। প্রতিবন্ধীরাও পারে, প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, কাজ শেখার সুযোগ পেলে তারাও দেশের মানবসম্পদ, তা-ই করে দেখাল এমডিপিওডি।

এনএ