শিখণ্ডী বাবু। প্রতিদিন রঙিলা সাজে বের হন। দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে ঘুরে টাকা তোলেন। কখনো শহরের রাস্তাঘাট, পাড়া-মহল্লায় নয়তো ট্রাফিক সিগন্যাল মোড়ে। আবার কখনোবা বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশনে। এসব জায়গাতে সপ্তাহের কোনো না কোনো দিন দেখা মিলবে বাবুর। দলের সঙ্গে থেকে অন্যের কাছে টাকাপয়সা চাওয়া, না পেলে গালাগালি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, তর্কে জড়ালে অপদস্থ করে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেন।

এসব করতে মন চায় না বাবুর। বরং স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নে সমাজসেবা থেকে নেওয়া কাপড় সেলাইয়ের প্রশিক্ষণকে কাজে লাগাতে চান তিনি। টাকা তোলা বা চাঁদাবাজি করে জীবিকা নির্বাহ থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছা আছে তার।

বাবুর মতো সমাজসেবা থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া রাশেদুল রুবেল, রুমা, অপু, দোলা, সজলও একই স্বপ্ন দেখছেন। তাদের কেউ দরজির  প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আবার কেউ নিয়েছেন রান্নাবিষয়ক ও পার্লারের প্রশিক্ষণ। কারও কারও রপ্ত হয়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। এমএসওয়ার্ড, এক্সেল ও পাওয়ার পয়েন্টের কাজের পাশাপাশি মোবাইল, রেডিও, টেলিভিশন সার্ভিসিং। তারা চান সবাই নিজেদের উপার্জিত আয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে।

রংপুর নগরীতে ও মিঠাপুকুরে তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন শিখণ্ডীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি জানা যায়। তবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত প্রশিক্ষণকে কেন তারা জীবন বদলানোর সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারছে না, এমন প্রশ্নের উত্তরে রংপুর নগরের শিখণ্ডীদের দলনেতা আনোয়ারুল ইসলাম রানা বলেন, শুধু প্রশিক্ষণ আর ১০ হাজার টাকা দিয়ে জীবন বদলানো সম্ভব নয়। স্বাবলম্বী হতে হলে অনেক কিছুই প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যেমন প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু করতে চাচ্ছি, তেমনি এই সমাজকেও আমাদের কিছু করার জন্য জায়গা করে দিতে হবে। সমাজ ও সামাজিকতা থেকে বৈষম্য দূর করে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।

সরকারিভাবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পেলেও বৈষম্যের শিকার হয়ে তাদের অভাবনীয় দুঃখ-কষ্টে জীবন কাটছে বলে আক্ষেপ করেন রংপুরের শিখণ্ডীদের এই দলনেতা। তিনি বলেন, মাত্র ৫০ দিনের প্রশিক্ষণ, একটা সনদ আর ১০ হাজার টাকা দিয়েছে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর। কিন্তু প্রশিক্ষণ আর ১০ হাজার টাকা দিয়ে এই যুগে স্বাবলম্বী হওয়া কখনোই সম্ভব না। এটা শুধু বাংলা সিনেমাতেই সম্ভব। বাস্তবে হয়তো ওই ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটা সেলাই মেশিন হতে পারে, কিছু কসমেটিক হতে পারে। কিন্তু ব্যবসার জন্য তো একটা জায়গার প্রয়োজন আছে। সেটা আমরা পাব কোথায়? আমাদের টাকাও নেই, আর কেউ আমাদের ব্যবসার করবার জায়গাও দেয় না। স্বাবলম্বী হতে চাইলে তো কিছু করার জন্য একটা জায়গা লাগবে। কিন্তু আমাদের তো সেই সামর্থ্য নেই। এ কারণে এসব ট্রেনিং কোনো কাজে আসছে না। তবে দু-একজন রয়েছে, যারা কষ্টের মধ্যেও স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করছে।

রংপুরের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ

তৃতীয় লিঙ্গ বা শিখণ্ডীদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারি নেওয়া মনঃসামাজিক প্রশিক্ষণ ও রিফ্রেশার্স প্রদান কর্মসূচির মেয়াদ আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়ে রুবেল বলেন, আমাদের প্রশিক্ষণের সময়টা অনেক কম। মাত্র ৫০ দিন। এর মধ্যে খামখেয়ালিপনা আর বুঝতেই তো দশ-পনেরো দিন চলে যায়। এ জন্য ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণ দিলে আরও সময় বাড়ানো দরকার। কেবল প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না, মনিটরিংয়েরও ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের প্রশিক্ষণকে কাজে লাগানোর সুযোগ ও পরিবেশ দিতে হবে। উপার্জনমূলক কাজে সম্পৃক্ত হতে না পারায় সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে দেওয়া কোনো প্রশিক্ষণের সার্থকতা থাকছে না।

সমাজসেবা থেকে বিউটি পার্লারের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন রাশি। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর পার্লার দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি হিজড়া হওয়ায় কেউ দোকান ঘর ভাড়া দেয়নি। অনেক চেষ্টা করে যখন পার্লার দিতে পারিনি। বরং বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আমার আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে দেওয়া হয়। ভালো আচরণ করা হয় না। বাধ্য হয়ে আবার ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় জড়িয়েছি। এখন আমার প্রশিক্ষণ আছে কিন্তু প্রয়োজনীয় মূলধন নেই।

রংপুরে তৃতীয় লিঙ্গের শিখণ্ডী ৩৭২ জন। তাদের মধ্যে রংপুরের নগরের নূরপুর জেএনসি রোডে (ছড়ারপাড়) একটি পুরোনো, স্যাঁতসেঁতে ও জরাজীর্ণ বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকছেন ৫০ জন। সেখানে তিনটা রুমে গাদাগাদি করে থাকেন তারা। শীতের সময় থাকতে কষ্ট না হলেও গরমকালে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাদের বেশির ভাগ সদস্যই ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় জড়িত। তবে অনেকেরই কম্পিউটার, বিউটিপার্লার, দরজি ও রান্নাবান্নার প্রশিক্ষণ রয়েছে। শুধু মূলধন আর কাজ করার জায়গা ও পরিবেশ না পাওয়ায় পিছিয়ে পড়েছে অবহেলিত এই জনগোষ্ঠী।

এদিকে রংপুরে ‘ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন শিখণ্ডীরা। এ ছাড়া রংপুর বিভাগে হাজারেরও বেশি তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

রংপুর জেলা সমাজসেবা আওতাধীন সামাজিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রের আওতায় ২০১৯ সালে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের ১০ জন সদস্য। কর্মদক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে ৫০ দিনব্যাপী তাদের শেখানো হয়েছে এমএসওয়ার্ড, এক্সেল ও পাওয়ার পয়েন্ট।

প্রশিক্ষক জিলহাজ উদ্দিন জনি বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের মেধা খুবই ভালো। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে যেকোনো বিষয় সহজে আয়ত্তে নিতে পারেন। তাদের মেধাকে কাজে লাগালে ভালো করতে পারবেন। খুব কম সময়ে তারা সহজেই শিখে যান। আরেক প্রশিক্ষক মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, তারা দুই ব্যাচে শিখে গেছেন। ৫০ দিন খুব কম সময়। আমরা এমএসওয়ার্ড, এক্সেল ও পাওয়ার পয়েন্টের পাশাপাশি আরও কিছু শেখাচ্ছি। যা তাদের কাজে লাগবে।

এ ছাড়া বিউটিফিকেশনে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১৪ জন ও ২৬ জন দরজিতে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রের আওতাধীন ৫০ দিনের কর্মসূচিকে অনেক কম সময় হিসেবে মনে করেন তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই।

সমাজসেবার আওতাধীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রের উপ-তত্ত্বাবধায়ক বেগম নাহিদা ইয়াসমিন বলেন, তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠী প্রচণ্ড মেধাবী, অল্পতেই শিখে যান। আমরা দুবার তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের ট্রেনিং দিয়েছি। তাদের সুযোগ দিলে আরও এগিয়ে যেতে পারবেন। ভবিষ্যতে আরও বেশি সদস্যকে ট্রেনিং দিতে পারব বলে আশা করছি।

গাড়িতে টাকা তোলেন তারা

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরাম রংপুর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এস এম পিয়াল বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্যে আসল-নকল রয়েছে। তবে কিছু ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি অনেক কমবে। তাদের জন্য যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের শুধু প্রশিক্ষণ ও অনুদান দিলে হবে না। প্রশিক্ষণ শেষে কাজের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। তাদের উপার্জনমূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে স্বাবলম্বী হতে অনুপ্রাণিত করতে হবে।

রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আব্দুল মতিন জানান, ইতোমধ্যে জেলার তালিকাভুক্ত ৩৭০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্য থেকে বিভিন্ন ট্রেডে ১৫০ জনকে ৫০ দিন এবং ৩০ জনকে ১২ দিন মেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন বয়স্ক ভাতা আর ১২ জন শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছেন। এ ছাড়া ১৫ জন বিভিন্ন কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছেন। প্রশিক্ষিতদের অনেকে স্বাবলম্বীও হয়েছেন।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবমতে, দেশে প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা ১২ হাজার। তবে এই জনগোষ্ঠীর দাবি, দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা দেড় থেকে দুই লাখ। সমাজসেবা অধিদপ্তর ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে তাদের জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি চালু করে। স্কুলগামী তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের (জনপ্রতি মাসিক প্রাথমিক ৭০০, মাধ্যমিক ৮০০, উচ্চমাধ্যমিক ১০০০ এবং উচ্চতর ১২০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি দিচ্ছে। ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে বিশেষ ভাতা হিসেবে জনপ্রতি মাসিক ৬০০ টাকা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ শেষে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে।

তবে তৃতীয় লিঙ্গের বেশির ভাগ মানুষের অভিযোগ, যারা প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন, তাদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে ১০ হাজার টাকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এই টাকায় এই যুগে কিছু করে খাওয়া কঠিন। টাকার পরিমাণ বাড়ানো এবং প্রশিক্ষণের মান উন্নয়নের বিষয়টিতে একমত সমাজসেবা অধিদপ্তরও।

এনএ