সরদাররাই শিশুদের ইটভাটায় নিয়ে আসেন
ইটভাটায় কাজ করছে শিশু
ইটভাটায় আগুনের পুড়ছে ইট। আর সেই সঙ্গে পুড়ছে শিশুর স্বপ্নও। অনেক শিশু লেখাপড়া বাদ দিয়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। পড়াশোনা না করে ইটভাটায় কাজে আগুনে প্রতিনিয়ত পুড়ছে হাজার হাজার শিশুর ভবিষ্যৎ। আর অধিক লাভের আশায় সরকারি আইন অমান্য করে প্রলোভন দেখিয়ে কম মজুরিতে ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে নিয়োগ করাচ্ছেন ভাটামালিকরা। উপজেলা প্রশাসন থেকে অভিযান পরিচালনা করা হলেও বন্ধ হচ্ছে না শিশু শ্রম।
এসব শিশুর কেউ কেউ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ এখন বিদ্যালয়মুখীও হচ্ছে না। অনেক শিশুরই দরিদ্র পরিবারে জন্ম। তাই তারা সামাজিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। একদিকে পরিবারে অভাব, অন্যদিকে একটু ভালো থাকার চেষ্টা। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছেন ইটভাটার মালিকরা।
বিজ্ঞাপন
আবার অল্প মজুরিতে শিশুদের এই বয়সে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিয়ে নেওয়া যায়। এতে ভাটামালিকদের আয় বাড়লেও শিশুদের বাড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ভোলায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না মেনে ইটভাটাগুলোতে বছরজুড়ে চলে আসছে শিশু শ্রমের মহচ্ছব। এমনটাই দেখা মিলেছে ভোলা সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইটভাটায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রখর রোদের মধ্যে কাজ করছে একদল শিশু। তাদের সবার বয়স ৭ থেকে ১৫ বা ১৭ বছর। পরিবারের অভাব ঘোচাতে ও খাবার জোগাতে মা-বাবার সঙ্গে জীবন-জীবিকার তাগিদে কাজ করছে এসব অবুঝ শিশু। সদর উপজেলার উওর দিঘলদী ইউনিয়নের মের্সাস রহমান ব্রিকস ফিল্ড, মিতালী ব্রিকস ফিল্ড, চরফ্যাশনের আলম ঝিকঝাক ব্রিকসসহ বেশ কয়েকটি ইটভাটায় এ অবস্থা দেখা গেছে।
বিজ্ঞাপন
ভোলা সদর উপজেলা পশ্চিম ইলিশায় ফাইভ স্টারে দেখা যায় দক্ষিণ চরপাতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মো. শাওন (১৪) ও মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র মহিম (৭) ওই ভাটায় কাজ করে। তারা ভাটা থেকে ট্রাক ও লরিতে ইট তুলে দেয় এবং ক্রেতার বাড়িতে তা নামিয়ে দিয়ে আসে। এ কাজ করার জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে পায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। ভোলা জেলায় মোট ইটভাটা রয়েছে ১২৫টি যার মধ্য চালু আছে ৯৫টি। এই ৯৫টি ইটভাটার মধ্য প্রায় অধিকাংশ ভাটায় অসংখ্য শিশু কাজ করছে। তাদের মধ্য অনেকে চুল্লিতে কয়লা বা কাঠ দেওয়ার কাজও করছে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় মাটিভর্তি ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাওয়ার কাজ করতে দেখা যায় এই শিশুদের।
ভোলা সদর সেভেন স্টার ব্রিকস ফিল্ডে গিয়ে দেখা যায়, রমজানসহ স্কুলপড়ুয়া কয়েকজন শিশু ইটভাটায় কাজ করছে। এক হাজার কাচা সাঁঝে করে ইট শুকানোর জন্য প্রতিজনকে দেওয়া হয় মাত্র দুই শ টাকা। অথচ এই কাজ করানোর জন্য একজন শ্রমিক নিয়োগ দিলে তাকে দিতে হতো ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। মজুরি সাশ্রয় করতে আইন অমান্য করে এভাবে শিশুদের কাজে লাগাচ্ছেন ভাটার মালিকরা।
এ ছাড়া সাতক্ষীরা ও খুলনাসহ অনেক জেলায় কম খরচে কাজের লোক পাওয়া যায়। কিন্তু শীতে কাজের চাপ থাকায় কাজের জন্য লোক না পাওয়ায় নিজ জেলা থেকে এসব শিশুকে দিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করানো হয়।
ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়ার ব্যাংকের হাটে অবস্থিত মেসার্স সুরমা ব্রিকস এর স্বত্বাধিকারী মো. সানজিদুল ইসলাম শুভর কাছে ইটভাটায় শিশুদের কাজে নিযুক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কোনো শ্রমিক নিয়োগ দিই না। সরদারের কাছে আমরা কাজ দিই। সরদাররাই কাজ উঠিয়ে দেয়। মূলত শিশুদের কেউ কাজে নেয় না। স্থানীয় কিছু শিশু কাঁচা ইট যখন চেঙ্গি (রোদে শুকানোর সময় উল্টিয়ে দেওয়া) দেওয়ার সময় হয়, তখন তারা নিজ ইচ্ছায় এসে চেঙ্গি দিয়ে যায়। পরে সরদার থেকে কিছু টাকা নিয়ে নেয়। তা ছাড়া আমাদের মালিক সমিতি থেকে শিশু শ্রমিক কাজে নেওয়া নিষেধ আছে।
ভোলা জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক তরিকুল ইসলাম কায়েদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ইটভাটা মালিক সমিতির আওতায় কোনো ইটভাটাতেই শিশু শ্রমিক নেই। আমাদের ভাটাগুলো শ্রম অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স করা। কেউ শিশু শ্রমিক নিয়োগ দিলে বা শিশুদের কাজে রাখলে তাদের জরিমানা করা হয়। কেউ যদি শিশু শ্রম করায় আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
ইটভাটায় শিশুর কাজ করা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়। ইটভাটায় দীর্ঘ সময় কাজ করার ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালুতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, এজমা, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। শিশুদের মৃত্যঝুঁকি থাকে এসব কাজ করলে।
ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম, সিভিল সার্জন, ভোলা
মানবাধিকার কর্মী আফজাল হোসেন বলেন, আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। এই শিশু বয়সে পড়াশোনা না করে কাজ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। ভবিষ্যৎতে শিক্ষার হার কমে যাবে। শিশু বয়সে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে প্রত্যেক অভিভাবককে, এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক আরিফ উদ্দিন রনি বলেন, পেটের দায়ে দারিদ্র্যের বেড়াজালে বন্দি হয়ে ইটভাটাগুলোতে প্রতিনিয়ত পুড়ছে এসব শিশুর ‘রঙিন’ভবিষ্যৎ। যে বয়সে তাদের থাকার কথা বাবা-মায়ের আদরে, সেখানে তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ব্যস্ত সময় পার করছে। এতে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে এসব শিশু। এখনই সময় এসব কাজ থেকে শিশুদের রক্ষা করা।
এদিকে ঢাকা পোস্টের ক্যামেরায় ইটভাটায় শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হয়, এমন ভিডিও ধারণ করে আনলে সেটি দেখে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমান উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা (এসি ল্যান্ড) আবু আবদুল্লাহ খানকে ঘটনাস্থলে পাঠান। ১০ ফেব্রুয়ারি ভূমি কর্মকর্তা এ অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা পান এবং অভিযুক্ত একজনকে ধরে আনেন। পরে মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেন। কিন্তু অভিযানের পরও শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর সত্যতা পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে ভোলা সদর ইউএনও মিজানুর রহমান বলেন, শ্রম আইন-২০০৬-এর ২৮৪ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করলে অথবা আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করে কোনো শিশুকে চাকরি করার অনুমতি দিলে তিনি পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যেসব ইটভাটায় শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সবাইকেই অনুরোধ করব শিশুদের দিয়ে যেন এমন কাজ না করা হয়।
রাকিব উদ্দিন অমি/এনএ