টাকার অভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া ছেলেটি এখন ৮০ বিঘা পুকুরে মাছচাষ করছেন। মাছ বিক্রির টাকায় ২০ বিঘা জমি কিনেছেন, বাড়ি বানিয়েছেন এবং কিনেছেন গাড়ি। মাছচাষ করে ছয় বছরে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বর্তমানে ছেলেটির মাসিক আয় সাত লাখ টাকা।

এমনি এক সফল মাছচাষি শাওন খান (২৮)। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের ছেলে তিনি। ১৯৯৩ সালে নিম্নবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। অভাবের সংসারে ঠিকমতো তিন বেলা খাবার জোটেনি। দিনমজুর বাবা পড়ালেখার খরচ দিতে পারেননি।

এ অবস্থায় সংগ্রাম করে নিজ গ্রামে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন শাওন। মাধ্যমিকে পড়াশোনা করেছেন আমলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তবে সপ্তম শ্রেণিতে উঠলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার। বই-খাতা কিনতে ও খরচ চালাতে না পারায় শাওনের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। সংসারে অভাব থাকায় তিন বছর পড়ালেখা বন্ধ থাকে। পরে আবার পড়াশোনা শুরু করেন। ২০১০ সালে এসএসসি পাস করেন। উপজেলার নওদা আজমপুর টেকনিক্যাল কলেজ থেকে ২০১২ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৫ সালে আমলা কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন তিনি।

শাওনের মাছের খামারে মাছ ধরছেন জেলেরা

এরপর সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখতে দেখতে কয়েক মাস কেটে যায়। এ সময় বেকার ঘুরে বেড়াতেন। এজন্য শাওনকে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর কটু কথা শুনতে হয়েছিল। 

এরই ‍মধ্যে এক বন্ধুর মাধ্যমে শাওন খবর পান উপজেলা মৎস্য অফিসে মাছচাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তখন তিনি মৎস্য অফিসে যান। পরে মাছচাষের প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রস্তুতি নেন। প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে সফল মাছচাষিদের গল্প জানতে পারেন। প্রশিক্ষণ শেষে মাছচাষে উদ্বুদ্ধ হন। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে বাড়ির পাশের এক বিঘা পুকুরে মাছচাষ শুরু করেন। ছয় বছর মাছচাষ করে এখন স্বাবলম্বী শাওন। মাছ বিক্রির টাকায় ২০ বিঘা জমি কিনেছেন, বাড়ি বানিয়েছেন এবং কিনেছেন গাড়ি। বর্তমানে বছরে তার আয় ৮৫-৯০ লাখ টাকা। সে হিসাবে মাসে তার আয় সাত লাখ টাকার অধিক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ৮০ বিঘা পুকুরে বিভিন্ন জাতের মাছচাষ করছেন শাওন। এর মধ্যে ২০ বিঘা পুকুর নিজের। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর কাছ থেকে ৬০ বিঘা পুকুর ইজারা নিয়েছেন। প্রতি বিঘায় বছরে ২০ হাজার টাকা ইজারা দেন। শাওনের পুকুরে রুই-কাতল, পাবদা, শিং, মৃগেল, সরপুঁটি, নাইলোটিকা ও সিলভার কার্প রয়েছে।

আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীর কাছ থেকে ৬০ বিঘা পুকুর ইজারা নিয়ে মাছে খামার করেছেন শাওন

মাছচাষে সফলতার বিষয়ে শাওন খান বলেন, উপজেলা মৎস্য অফিসে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরই মাছচাষে উদ্বুদ্ধ হই। ২০১৫ সালে বাবা ও মৎস্য কর্মকর্তার সহযোগিতা এবং পরামর্শে বাড়ির পাশের এক বিঘা পুকুরে মাছচাষ শুরু করি। বছর শেষে ভালো আয় হয়। ২০১৬ সালে মৎস্য অফিস থেকে লোন নিয়ে তিনটি পুকুর ইজারা নিয়ে মাছচাষ করি। ২০১৭ সালে আরও পাঁচটি পুকুরে মাছচাষ করি। ২০১৮ সালে আরও ৫০ বিঘা জমির পুকুরে মাছচাষ করি। বর্তমানে ৮০ বিঘা পুকুরে মাছচাষ করছি। এর মধ্যে ২০ বিঘা নিজের পুকুর। বাকি ৬০ বিঘা ইজারা নেওয়া। এর মধ্যে ফার্মের রোড এলাকায় ২০ বিঘা, আমলায় ২০ বিঘা, শাহাপুরে ছয় বিঘা, চরপাড়ায় ছয় বিঘা, ধলসা ও কুশাবাড়ি এলাকায় ২৮ বিঘা আয়তনের পুকুরে মাছচাষ করি।

প্রতি বিঘা পুকুরে মিশ্র মাছচাষ করতে বছরে এক লাখ টাকা খরচ হয়। মাছ বিক্রি হয় দুই লাখ টাকার। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বিঘায় ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়। আমার ৮০ বিঘা পুকুরে বছরে ৮৫-৯০ লাখ টাকা আয় হয়।

শাওন খান, সফল মাছচাষি

ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখতাম। মাছচাষ শুরুর পর সরকারি চাকরির কথা ভুলে গেছি। এখন চাকরি করার ইচ্ছা নেই। প্রতি বছরই আয়ের পরিমাণ বাড়ছে। মাছচাষ নিয়েই থাকতে চাই। আগামীতে সবমিলে ১০০ বিঘা পুকুরে মাছচাষ করব। মাছচাষের টাকা দিয়ে ২০ বিঘা জমি কিনেছি। সেগুলোতে পুকুর কেটে এখন মাছচাষ করছি। গাড়ি কিনেছি, বাড়ি করেছি। বলতে গেলে মাছচাষ করে আমি জিরো থেকে হিরো।

এদিকে শাওনের মাছের খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেকের। শাওনকে দেখে এলাকার অনেক বেকার যুবক মাছচাষ শুরু করেছেন। অনেকেই শাওনের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন।

শাওনের মাছের খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেকের

শাওনের মাছের খামারের শ্রমিক আশু আলী বলেন, শাওনের পরিবার খুব গরিব ছিল। অর্থের অভাবে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খুব কষ্ট করে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি না পেয়ে মাছচাষ শুরু করে শাওন। এখন তার খামারে আমরা ৪০ জন কাজ করি। মাছচাষে শাওনের ভাগ্য বদলে গেছে, আমাদেরও কর্মসংস্থান হয়েছে। আমরা সবাই ভালো আছি।

মাছচাষে সফলতার নেপথ্যের কথা জানিয়ে শাওন বলেন, সবসময় পুকুরের আগাছা ও আবর্জনা পরিষ্কার করি। নিয়মিত ভালো মানের খাবার দিই। ভালো জাতের মাছের পোনা সংগ্রহ করি। মাছের পোনা ভালো হলে উৎপাদন ভালো হয়। আমি নিয়মের বাইরে যাই না। প্রশিক্ষণ নিয়ে মাছচাষ শুরু করেছিলাম। বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুযায়ী মাছচাষ শুরু করছি। কোনো সমস্যায় পড়লে মৎস্য কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিই। এজন্য মাছচাষ করে লোকসান হয়নি।

মাছের মিশ্র চাষের কারণ জানতে চাইলে শাওন বলেন, মাছের মিশ্র চাষ লাভজনক। সঠিক পদ্ধতিতে মাছের মিশ্র চাষ করলে ঝুঁকি কম, খরচও কম। ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। পুকুর নির্বাচন ও পুকুর প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থাপনার ওপর মাছচাষের সফলতা নির্ভরশীল। সারা বছর পানি থাকে অথবা মৌসুমি পুকুর; এই দুই ধরনের পুকুরে মাছের মিশ্র চাষ হয়। তবে যারা মাছচাষ শুরু করতে চান; তারা অবশ্যই মৎস্য কর্মকর্তা ও মাছচাষিদের পরামর্শ ও সহযোগিতা নেবেন।

বর্তমানে ৮০ বিঘা পুকুরে মাছচাষ করেন শাওন

মিরপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রাজিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শাওন মাছচাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। মিরপুর উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাছচাষ শুরু করেন তিনি। ছয় বছরে কোটিপতি হয়ে গেছেন। বর্তমানে ৮০ বিঘা পুকুরে মাছচাষ করেন। তার সফলতা দেখে অনেক বেকার যুবক মাছচাষ শুরু করেছেন। তারাও এখন স্বাবলম্বী। যারা মাছচাষে আগ্রহী আমরা তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিই।

কুষ্টিয়া জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সাজদার রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুষ্টিয়ায় যুবকরা মাছচাষে ঝুঁকছেন। ইতোমধ্যে অনেক বেকার যুবক মাছচাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। দিনদিন মাছচাষে বেকার যুবকদের সংখ্যা বাড়ছে। যারা মাছচাষ করছেন, তাদের জেলা ও উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দিচ্ছি আমরা।

এএম