আমেনা বিবি। পরিবারের দারিদ্র্য ও অসচ্ছলতা দূর করতে নাটোরের প্রাণ অ্যাগ্রো ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ ১৫ বছর সেখানে কাজ করে এখন তিনি এখন স্বাবলম্বী। কঠোর পরিশ্রম আর দীর্ঘ ধৈর্য ও একাগ্রতায় আজ তিনি জীবনযাপনে সফল হয়েছেন। তিনি মনে করেন, এই প্রতিষ্ঠান আজ তাকে অদম্য একজন নারী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে সমাজে।

আমেনা বিবি নাটোর সদর উপজেলার চানপুর গ্রামের বাসিন্দা। এক সময় সংসারে প্রচণ্ড অভাব ছিল। স্বামীর আয়ে সংসার ঠিকমতো চলত না। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্টে কেটেছে দিন। কোনো দিন এক বেলা খেয়ে না খেয়ে কেটে গেছে। তবু হাল ছাড়েননি আমেনা বিবি। পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর সততাকে আশ্রয় করে কাজ শুরু করেছিলেন প্রাণ অ্যাগ্রো-ফ্যাক্টরিতে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ও নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে আজ স্বাবলম্বী নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।

এখানে টমেটো সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়

ঢাকা পোস্টকে তার দীর্ঘ পথচলার কথা জানান আমেনা বিবি। তিনি বলেন, কোম্পানিটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আমরা খুব লাভবান হয়েছি, আমাদের উন্নতি হয়েছে। আগে আমরা ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভাত-কাপড়ের জন্য অনেক কষ্ট করেছি। এখন কোম্পানিটি আসায় আল্লাহর রহমতে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করাতে পারছি। সুখে জীবনযাপন করতে পারছি। আমরা কিছু টাকা ক্যাশও করতে পারছি। ওই ক্যাশ দিয়ে পাঁচ কাঠা জমি কিনেছি, বাড়ি করেছি। এর আগে অনেক কষ্ট করেছি, কিছুই করতে পারিনি। এখন খুব ভালো আছি।

জানা যায়, দেশের উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি কৃষিজাত পণ্য উৎপাদিত হয়। সে জন্য প্রাণ কোম্পানি নাটোরে অ্যাগ্রো ফ্যাক্টরি স্থাপন করেছে। কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তার লক্ষ্যেই তারা ২০০১ সালে নাটোরের একডালায় স্থাপন করে প্রাণ অ্যাগ্রো ফ্যাক্টরি। সারাদেশে প্রায় আট হাজার মানুষ প্রাণ কোম্পানিতে কাজ করেন।

উৎপাদন কাজে নিয়োজিত কর্মীরা

আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ ১২৫ বিঘা আয়তনের প্রাণ কারখানায় জ্যাম-জেলি, মসলা, সস, আচার, চাটনি, নুডলস, সরিষার তেল, চাল, বাদাম, ডাল, দুধ, লাচ্চাসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের জন্য এখানে প্রোডাকশন লাইন চালু রয়েছে। এ ছাড়া আম ও টমেটো মৌসুমে সেগুলো সংগ্রহ করে এ ফ্যাক্টরিতে পাল্প তৈরি করা হয়।

বছরজুড়ে প্রাণ অ্যাগ্রো কারখানায় প্রায় সাত হাজার লোক নিয়োজিত থাকেন এসব পণ্য উৎপাদন কাজে। এ ছাড়া আম ও টমেটোর মৌসুমে আরও প্রায় দুই হাজার লোকের বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কর্মরত এসব শ্রমিকের অধিকাংশই নারী। ফলে সামাজিকভাবে তারা যেমন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন, পরিবারেও আসছে সচ্ছলতা। নারী কর্মীদের অধিকাংশই নাটোর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাস করেন।

এ বিষয়ে একডালা এলাকার স্বাবলম্বী নারী মলিদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ১০ বছর ধরে প্রাণ কোম্পানিতে কাজ করি। এখানে কাজ করে জীবনে ভালোই উন্নতি করেছি। ঘরবাড়ি করেছি, মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছি আরও অনেক কিছু করেছি। কোম্পানিটি আরও উন্নতি হোক ও বড় হোক। আরও মানুষের কর্মস্থান হোক। কোম্পানির উন্নতি হলে আমাদের ও এলাকার উন্নতি হবে।

শরিফুল ইসলাম নামে এক কর্মী বলেন, ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোম্পানিতে যোগদান করি আমি। আমাদের এখানে ফ্যাক্টরি হওয়ায় আমরা আজ স্বাবলম্বী। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করছি। এর আগে তো বেকার ছিলাম। এখানে একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। এ কারণে আমরা খুব ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারছি।

কারখানায় কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা

কাঁচামাল সরবরাহ কমিটির সভাপতি মো. আফছার আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ১৯৯৮ সাল থেকে প্রাণ কোম্পানির সঙ্গে জড়িত। প্রাণ কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার যখন জমি কিনতে প্রথম এখানে আসেন, তখন আমাদের ধারণা হয় যে এখানে একটা শিল্পপ্রতিষ্ঠান হলে কর্মসংস্থান বাড়বে। সেদিক বিবেচনা করে আমরা স্বল্প মূল্যে জমি প্রাণ কোম্পানিকে দেই।

তিনি আরও বলেন, ২০০১ সাল থেকে এখানে উৎপাদন শুরু হলে আমরা সব ধরনের কৃষিপণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করার সুযোগ পাই। বিক্রি করে আমরা এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছি। এখানে এলাকার অনেক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

কারখানায় জ্যাম-জেলি, মসলা, সস, আচার, চাটনি, নুডলসসহ নানা পণ্য উৎপাদন হয়

এ বিষয়ে ২ নম্বর তেবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. খাজামুদ্দিন বলেন, অসহায় ও বেকার যেসব লোকজন আছেন, তারা প্রাণের কারখানায় চাকরি পেয়েছেন। আমার ওয়ার্ডের প্রায় এক হাজার মানুষ এখানে কাজ করছেন। সবাই এখন ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারছেন।

২ নম্বর তেবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. ওমর আলী প্রধান ঢাকা পোস্টকে জানান, ২০০১ সালে কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই এলাকার কয়েক হাজার নারী-পুরুষ কাজ করছেন। তারা এখন স্বাবলম্বী। কোম্পানির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ও উন্নতি কামনা করেন তিনি।

এ বিষয়ে নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নাটোর-২ (সদর ও নলডাঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম শিমুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাটোরে প্রাণ কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এলাকার অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই এলাকার স্বল্পশিক্ষিত মানুষগুলো কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে। এ ধরনের শিল্প-কলকারখানা যদি আরও স্থাপিত হয় তাহলে নাটোরের বেকার সমস্যার সমাধান হবে এবং সব মানুষ কর্মমুখী হবে। নাটোরকে বদলে দিয়েছে প্রাণ অ্যাগ্রো লিমিটেড। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আরও বেশি গড়ে উঠুক- এই প্রত্যাশা করি।

এনএ/আরএআর