কোটি টাকার বই আমদানি করে বেকায়দায় ব্যবসায়ীরা
মানিকগঞ্জে বই ব্যবসায় ভাটা
‘স্কুল-কলেজ বন্ধ। তাই বইয়েরও বিক্রি নাই। করোনা আইসা বইয়ের ব্যবসায় ভাটা ফালাই দিছে। কোনোমতে দোকান চালাইতাছি। কর্মচারীরও বেতন আগের মতো দিবার পারি না। কবে যে করোনা দেশ থাইকা যাইব আর আমগো কপাল খুলব। বছর তো চলেই গেল। এখন ঋণের বোঝা নিয়েই নতুন বছরের আশায় আছি।’
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কথাগুলো বললেন মানিকগঞ্জ জেলা শহরে সাথী লাইব্রেরির মালিক মোশারফ হোসেন।
বিজ্ঞাপন
গত বছরের ২৬ মার্চ থেকেই করোনার সংক্রমণ রোধে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারা দেশের মতো মানিকগঞ্জেও বন্ধ রয়েছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। এ কারণে বই বিক্রি না থাকায় এবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পুস্তক ব্যবসায়ীরা। অনেকের ব্যবসা বন্ধের উপক্রম। অনেকে পরিবার নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। করোনার কারণে লোকসান গুনছেন মানিকগঞ্জের প্রায় ২৫০ বই বিক্রেতা।
বাংলাদেশ বই পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির মানিকগঞ্জ জেলা শাখার দেওয়া তথ্যমতে, মানিকগঞ্জের সাতটি উপজেলা মিলে প্রায় ২৩০ জন বই ব্যবসায়ী (বিক্রেতা) রয়েছেন। এর মধ্যে জেলা শহরে বই ব্যবসায়ী (বিক্রেতা) রয়েছেন ১৮ থেকে ২০ জন। ২০১৯ সালে বই বিক্রি মৌসুমে জেলায় আনুমানিক ১৯ থেকে ২০ কোটি টাকার বই আমদানি করা হয়। তখন ২০ থেকে ২২ কোটি টাকার বই বিক্রিও হয়েছে। আর গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় আড়াই কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
গত বছরের শুরুর দিকে লাখ থেকে কোটি টাকার বই আমদানি করে বেকায়দায় ব্যবসায়ীরা। অনেকে আমদানি করা বই বিক্রি না হওয়ায় প্রকাশনীকে ফেরতও দিয়েছেন। বই বিক্রিতে ভাটা পড়ায় দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতনসহ অন্যান্য ব্যয় জোগানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তবে সামনের নতুন বছরে স্কুল-কলেজ খুলবে, এমন প্রত্যাশায় রয়েছেন বলে জানান বই বিক্রেতারা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মানিকগঞ্জ জেলা শহরের লাইব্রেরিগুলোর আলমারিতে সাজানো সারি সারি বিভিন্ন ধরনের বই। তবে ক্রেতা না থাকায় মালিকসহ কর্মচারীরা অলস সময় পার করছেন। মাঝেমধ্যে দু-চারজন ক্রেতা এলেও বই না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন। আবার দু-একজন ক্রেতা তাদের প্রয়োজনীয় বই কিনছেন। বই বেচাকেনা না থাকায় তাদের সময় কাটছে মোবাইলে ফেসবুক, ইউটিউব, গল্পের বই ও খবরের কাগজ পড়ে।
জেলা শহরের ভাষাশহীদ রফিক সড়কে অবস্থিত আজাদ লাইব্রেরির মালিক অপু খান বলেন, করোনায় বই বিক্রিতে ভাটা পড়ছে। বেচাকেনা নাই বললেই চলে। প্রতি মাসে দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতনসহ প্রায় লাখ টাকার মতো খরচ। আর বই বিক্রি করতে পারি মাত্র ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। মাস শেষে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়।
তিনি আরও বলেন, গত বছরের শুরুতে (জানুয়ারি) প্রায় তিন কোটি টাকার বই আমাদানি করে বিপাকে আছেন। প্রতি মাসে লোকসান গুনতে গুনতে ঋণের বোঝা ভারী হচ্ছে। সামনের বছরে আল্লাহর ওপর ভরসা করে আছেন।
সাথী লাইব্রেরির মালিক মো. মহিউদ্দিন বলেন, করোনা আসার আগে দুই দোকান মিলে প্রায় ৩০ লাখ টাকার নতুন বই আমদানি করছিলাম। দীর্ঘদিন দোকান বন্ধ থাকায় আয়-রোজগারও বন্ধ ছিল। তাতে অনেক টাকার ঋণে পড়েছি। আগে প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বই বেচাকেনা হতো। এখন সারা দিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকার বই বিক্রি করতে পারি।
দেশ লাইব্রেরির মালিক মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, করোনাকালীন দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতনসহ অন্যান্য খরচ ওঠে না। সারা মাসে ১০ ভাগ বইও বিক্রি হয় না। করোনার সময়ে যদি ৬০ ভাগ বইও বিক্রি হলেও ডাল-ভাত খাইয়া বাঁচা যাইত। আমাদের তো কিছুই করার নাই, তাই নতুন বছরের দিকে তাকিয়ে আছি।
লাইব্রেরির কর্মচারী মো. কামাল বলেন, গত বছর এই সময়ে পানি খাওয়ার সময় পাই নাই। আর অহন অলস বইসা থাকা লাগে। দোকানে বইয়ের ক্রেতা কম। তবে আমার মালিকের ব্যবসা মন্দা থাকা সত্ত্বেও আমাগো কর্মচারীর বেতন বকেয়া রাখেন নাই।
এদিকে অনেক লাইব্রেরির মালিক বেচাবিক্রি না থাকার কারণে দোকানের কর্মচারীদের বিদায় বলে দিয়েছেন। কারণ হিসেবে তারা জানান ব্যবসায় ভাটা পড়ার কথা। আবার ঋণের বোঝা ভারী হচ্ছে। তাই এ মুহূর্তে বিদায় বলা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখেন না পুস্তক বিক্রেতারা।
চাকুরিচ্যুত এক লাইব্রেরি কর্মচারী তৌফিক আহমেদ বলেন, করোনাকালীন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় লাইব্রেরিয়ানদের বেচাকেনা নাই। এখন আমার মালিক যদি লাভ পাঁচ টাকা করেন, তার তিন টাকা থাকলে বাকি দুই টাকা দিয়ে খরচ চালান তিনি। তিনি যখন খরচ চালাইতে পারতাছেন না, আমাদের আর রাখার কোনো প্রয়োজন মনে করছেন না। মালিকদের ব্যবসা আগের মতো চাঙা হচ্ছে না আর আমাদেরও ডাকছেন না। আমরা বেকারের মতো বসে আছি। কোনো কাজও পাই না। খাইয়া না-খাইয়া দিন চইলা যাইতাছে। কারও কাছে হাতও পাতা যায় না, কষ্টের কথা বলাও যাইতেছে না।
তিনি আরও বলেন, এখন কারও কাছে ওই রকম কাজও নাই, যার কারণে আমরাও নিরুপায়। মাঝেমধ্যে এর-ওর বাড়িতে কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করে চলছি। আর সব সময় তো কৃষিকাজ থাকে না। আমার বাড়িতে সদস্য চারজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এই খাতে কতটুকু করছেন, তাও জানি না।
কর্মচারী বিদায়ের প্রসেঙ্গ এক মালিক জানান, করোনা যেভাবে চলতাছে এইভাবে চলতে থাকলে আমাদের ব্যবসা আসলে টেকা বড়ই কষ্ট। আর আমার কর্মচারী ছিল দুইটা, কর্মচারীর সাথে সম্পর্ক ভালো কিন্তু করোনার ওই অবস্থার কারণে আমিও রাখতে পারি নাই। আমি বলেছি তাদের, অবস্থা ভালো হলে তুমি তখন চইলা আইসো। আর্থিক অবস্থা তো খারাপ, আমি নিজেই চলতে পারতাছি না, কীভাবে কর্মচারী রাখব।
দিক দর্শন প্রকাশনীর মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি বলেন, প্রায় মার্চ মাস থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খুবই খারাপ, লাইব্রেরিয়ানদের সেল নাই, সেখানে আমাদের কোম্পানিরও সেল নাই। আর কোম্পানির সেল না থাকায় আমরা যারা বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে চাকরি করছি, তাদের বেতন-ভাতা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসছে। এটা কোম্পানির ব্যর্থতা বলব না। সে ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থাও খারাপ, কোম্পানির অবস্থাও খারাপ। যখন স্কুল-কলেজ খুলবে, তখন আমাদের বই ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে। আমারা বেতন-ভাতা নিয়ে ভলোভাবে চলতে পারব। এই কঠিন অবস্থায় সংসার পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা দেনা করে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ করে চলতাছি।
লাইব্রেরিতে বই কিনতে আসা এক শিক্ষার্থী বলেন, আগের মতো বই প্রয়োজন হয় না। কারণ এখন অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। যে কারণে আমাদের বইয়ের প্রয়োজন হয় না। তাই বই কেনার দরকার হচ্ছে না। অনলাইনে ক্লাস করার সময় নোট করছি। তবে চলতি বছরের ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ খুললে হয়তো আবার বই কিনব।
সন্তানের জন্য বই কিনতে আসা দুজন অভিভাবক জানান, করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই অনলাইনে ক্লাস হওয়ার কারণে শুধু খাতা-কলম প্রয়োজন হয়। তাই এখন বই কেনার দরকার নেই। ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ খুলবে, তখন আবার কিনব।
অনুপম প্রকাশনীর মানিকগঞ্জের প্রতিনিধি শামীম হোসেন বলেন, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই বই প্রকাশনী ও বিক্রেতাদের ব্যবসা। যেহেতু করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, তাই বই বিক্রিও কম। মানিকগঞ্জ জেলায় প্রায় ২৫টি বই প্রকাশনীর প্রতিনিধি কাজ করে। বই বিক্রি কমে যাওয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও এসব প্রতিনিধিকে ঠিকমতো বেতনও দিচ্ছে না। জেলার বই বিক্রিতাসহ আমরাও নতুন বছরের আশায় রয়েছি।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মানিকগঞ্জে এবার শতকরা দশ ভাগ বই বিক্রি হয়েছে। করোনাকালীন বছরে জেলায় ৯০ ভাগ ব্যবসা নেই। যে কারণে অনেক ব্যবসায়ী ঋণের জালে পড়েছেন। সামনের বছর স্কুল-কলেজ খুললে হয়তো বই ব্যবসায়ীরা ঋণ কিছুটা পরিশোধ করতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এনএ