তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে শাদমান বিশ্বাস (১০)। তবে মা-বাবার দেওয়া নাম বাদ দিয়ে সবাই তাকে ‘খুদে মুজিব’ বলে ডাকেন। কারণ, পাঁচ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ মুখস্থ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনিয়ে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে শাদমান। এখন রেসকোর্স ময়দানে নিজ কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভাষণ শোনাতে চায়।

যশোর সরকারি মহিলা কলেজ-সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা শাদমান বিশ্বাস শহরের সেক্রেড হার্ট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। শাহীনুর রহমান ও শিমু পারভীন দম্পতির একমাত্র সন্তান সে।

শাদমান বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে জানায়, বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার জীবন খুঁজে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে। এই তিন জয়ের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে বুকে লালন করে তার ভাষণ শিখেছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কোনো এক ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে নিজের কণ্ঠে সেই ভাষণ শোনাতে চাই, এটা আমার স্বপ্ন।

শাদমানের বাবা শাহীনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৬ সালে শাদমানের বয়স যখন পাঁচ, তখন তাকে প্লে শ্রেণিতে ভর্তি করি। তখন তার একমাত্র কাজ ছিল স্কুলে যাওয়া আর টিভিতে কার্টুন দেখা। মাঝেমধ্যে টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মনোযোগ দিয়ে শুনত। এটা দেখার পর আমার কাছে ভাষণ সম্পর্কে জানতে চাইত। বলত, প্রায় টেলিভিশনে একটি মানুষ স্বাধীনতার কথা, রক্ত দেওয়ার কথা বলে। কেন বলে বাবা? পরে শাদমানকে আমি স্বাধীনতা আর বঙ্গবন্ধুর গল্প বলি। শাদমান বঙ্গবন্ধুর জীবনী শুনে বায়না ধরে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাবে। তাকে বললাম, বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই। পরে তাকে ১৫ আগস্টের ইতিহাস শোনালাম। শুনে সে বলে, এমন একজন মানুষকে কেউ হত্যা করতে পারে! এরপরও বায়না ধরে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাবে।

তারপর তাকে আবারও বোঝালাম, বঙ্গবন্ধু নেই। তার কয়েক মাস পর ১৫ আগস্ট যশোর শহরের বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে তাকে নিয়ে যাই ফুলের শ্রদ্ধা জানাতে। সবাই শ্রদ্ধা জানালেও সে ফুল নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। বারবার ম্যুরালে ফুল দিতে বললেও সে দেয় না। তখন সে বলে আমি ফুল বঙ্গবন্ধুর হাতেই দেব। বঙ্গবন্ধু আসবে, রাসেল ভাইয়ার হাত ধরে ফুল দেব। পরে বিভিন্ন নেতাকর্মী তাকে বোঝানোর পর ফুল দিয়ে কান্না করতে করতে বাসায় আসে। বাসায় এসে আবদার করে বলে, টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণ প্রচার হয়, সেগুলো আমাকে শিখিয়ে দাও! আমি তখন শাদমানকে বললাম ভাষণটা শিখে তুমি কী করবে। তখন সে বলে, আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাষণটা বলব। ভাষণটি শুনে ঠিকই বঙ্গবন্ধু আমার কাছে আসবে। অব্যশই আসবে।

ভাষণ শুনিয়ে সনদ পায় শাদমান

শাহীনুর রহমান বলেন, আমার তত্ত্বাবধানে অল্প অল্প করে পুরো ভাষণটি মুখস্থ করে শাদমান। তারপর বিভিন্ন কর্মসূচি বা জাতীয় অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে লাগল। ২০১৬ সাল থেকে শাদমান অর্ধশতাধিক স্থানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ পরিবেশন করেছে। ভাষণ মুখস্থ করার পর স্থানীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তা পরিবেশন করে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। শুধু প্রশংসাই নয়, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতায় ভাষণ পরিবেশন করে পেয়েছে বহু পুরস্কার এবং সনদও। ভাষণ পরিবেশন করে প্রথমে জেলা, পরে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পুরস্কার ও সদন অর্জন করেছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীও তাকে সদন দিয়েছেন। নাট্যকার ও লেখক আবুল হাসান তুহিন শাদমানের জীবনী নিয়ে ‘আগামীর বঙ্গবন্ধু’ নামে একটি নাটক লিখেছেন। আমার ছেলে যখন ভাষণটি পরিবেশন করে তখন বাবা হিসেবে আমি গর্ব করি। এটি সাধারণ কোনো ভাষণ নয়। বিশ্বের যে কয়টি উল্লেখযোগ্য ভাষণ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি অন্যতম। ইতোমধ্যে ইউনেসকো ভাষণটিকে শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা আমাদের জন্য গর্বের।

শাদমান এখন বুঝতে শিখেছে। বঙ্গবন্ধু কোনো দিন ফিরবেন না। তার সঙ্গে দেখাও করবেন না। কারণ, দুই বছর আগে শাদমান আমাকে বলেছে, বঙ্গবন্ধু আর না ফিরলেও বাঙালির জাতির মাঝে বেঁচে রয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে শিশুদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে হলে শাদমানের মতো সবাইকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মুখস্থ করানো কিংবা একবার হলেও শোনানো উচিত।

শাহীনুর রহমান

দেশের প্রতি জেলায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানিয়ে শাহীনুর রহমান বলেন, প্রতি জেলায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হলে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারবে।

শাদমান জানায়, বঙ্গবন্ধুর সব ভাষণ পরিবেশন করতে আমার ভালো লাগে। ৭ মার্চের ভাষণটি সবচেয়ে বেশি পরিবেশন করেছি। ভাষণটি দেশ স্বাধীনের জন্য মানুষকে সাহস জুগিয়েছিল। আমাকে দেখে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুখস্থ করার চেষ্টা করেছে অনেক শিশু। নিজের স্কুলে এবং পরিচিত শিশুদের মুখস্থ করাতে সহযোগিতা করেছি। পুরো ভাষণ মুখস্থ করতে পারলেও অনেক শিশু মনে রাখতে পারে না। দেশের সব শিশু যদি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেখে, তাহলে তাদের মনে বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা আরও বেড়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলাদেশ গড়ার। এই শিশুদের মাধ্যমে একদিন সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।

শাদমানের কণ্ঠে বহুবার বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর মতো উপমহাদেশে আরেকজন নেতা হবেন কি না, সন্দেহ আছে। তবে শাদমানের ভেতরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, চিন্তা-চেতনা, ত্যাগ এগুলো প্রস্ফুটিত হবে, এটা নিশ্চিত। তার জন্য ভালোবাসা আর দোয়া রইল।

এনএ