১৪ বছর স্বামী নিখোঁজ, মেয়েকে ব্যাংকার বানালেন মা
প্রতীকী ছবি
প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের দুদিন আগে সাগরে মাছ ধরতে যান বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার দরিদ্র জেলে আলমগীর হোসেন (ছদ্মনাম)। ১০ বছরের মেয়ে আর পাঁচ বছরের ছেলেকে ঘুমে রেখে ফজরের সময় সাত জেলের সঙ্গে সাগরে যাত্রা করেন তিনি। এরপর দীর্ঘ ১৪ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি আলমগীরের।
সেই থেকে দুই শিশু সন্তান নিয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু হয় স্বামীহারা ফাহিমা বেগমের (ছদ্মনাম)। দুঃখ-দুর্দশা আর লাঞ্ছনা-বঞ্চনার সেই জীবন নিয়ে দুই সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে নেন ফাহিমা। শত কষ্টের মাঝেও দিশেহারা হননি দুঃখিনী মা ফাহিমা। তার হাড়ভাঙা খাটুনি আর নিজস্ব বুদ্ধিমত্তায় বাবাহারা মেয়ে মারিয়া (ছদ্মনাম) এখন চাকরি করছেন রাষ্ট্রায়ত্ব একটি ব্যাংকে। আর একমাত্র ছেলে সজীব অনার্সে ভর্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
শত কষ্ট আর হাড়ভাঙা খাটুনির স্মৃতি মনে পড়তেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন ফাহিমা বেগম। লোকলজ্জার ভয়ে দুঃখ-দুর্দশা আর দুর্বিসহ সেই জীবনের কথা অন্যদের জানাতেও চান না তিনি। তাই এই সংবাদে তাদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু বরগুনাতেই এ রকম শত শত জেলে আছেন, যারা সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে জলদস্যুদের হাতে নিহত হয়েছেন অথবা ঝড়ের কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন কিংবা নিখোঁজ হয়েছেন। এই জেলেদের পরিবারের খবর কেউ রাখে না।
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, স্বামী মারা গেলে কিংবা নিখোঁজ হলে বিধবা জেলে বধূরা অন্যত্র বিয়ে করেন। তখন তাদের সন্তানদের আশ্রয় হয় দাদা কিংবা নানাবাড়িতে। লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, অবজ্ঞা এবং অবহেলায় দুবেলা খাবার খেয়ে শুধুমাত্র তারা বড়ই হয়। শিক্ষা তো দূরের কথা, বাবাহারা অধিকাংশ শিশুর পা রাখারও সুযোগ হয় না স্কুলের বারান্দায়। স্বামীকে হারানোর পর ফাহিমা বেগম তার ছেলে ও মেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। স্বামী হারানোর পর জেলে পরিবারে এ রকম ঘটনা এর আগে আমি আর শুনিনি।
অতীতের সেসব দুঃখ-দুর্দশার কথা জানতে চাইলে আবেগতাড়িত হয়ে ঢাকা পোস্টকে ফাহিমা বেগম বলেন, বসতঘর ছাড়া আমাদের আর কোনো সহায় সম্পদ ছিল না। আমার স্বামী মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সিডরের দুদিন আগে তিনি সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। এরপর সিডরের আঘাতে আমাদের ঘরটিও লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ছোট দুই শিশু সন্তান নিয়ে জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়লেও কোনোরকম প্রাণে বাঁচি আমরা।
তিনি আরও বলেন, আমার স্বামী যখন নিখোঁজ হয় তখন আমার মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আর ছেলে কেবল স্কুলে ভর্তি হয়েছে। স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আমি আমার ছেলে ও মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে নিই। ওদের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া ছিল আমার কাছে অনেক কষ্টের। কারণ আমাদের কোনো সহায় সম্পদ ছিল না। তাই আমি এমন কোনো কাজ বা পরিশ্রম করা বাদ রাখিনি যার মাধ্যমে টাকা উপার্জন করা যায়। আমাদের সেই ঘোর বিপদের দিনে তেমন কেউ এগিয়েও আসেননি।
ফাহিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওই সময় কেউ পাশে না দাঁড়ালেও অভাব অনটনের কারণে অনেকেই আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু আমার মেয়ে লেখাপড়ায় ভালো থাকার কারণে আমি কারও কথায় কান দেইনি। আজ আমার সব পরিশ্রম সফল হয়েছে। আমার মেয়ে একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে চাকরি করে।
এ বিষয়ে ফাহিমা বেগমের ছেলে সজীব (ছদ্মনাম) ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ছোট থাকা অবস্থায়ই আমার বাবা সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন। এরপর তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি। আমার মায়ের শত কষ্টের জন্যই আমরা এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি এখন অনার্সে ভর্তির অপেক্ষায় আছি। আর আমার বড় বোন রাষ্ট্রায়ত্ব একটি ব্যাংকে চাকরি করছেন। এ অবদান শুধু আমার মায়েরই।
এ বিষয়ে মেয়ে মারিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মায়ের জন্য আমার গর্ব হয়। একজন মা চাইলে অসাধ্যকেও সাধন করতে পারেন, তা আমার মা প্রমাণ করে দিয়েছেন। আমার বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর আমার মা যদি অন্যদের কথামত আমাকে বিয়ে দিতেন বা অভাবের তাড়নায় আমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিতেন তাহলে আমি কখনোই এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না।
জানা গেছে, পাথরঘাটার একটি স্কুল ও একটি কলেজ থেকে ২০১২ সালে এসএসসি ও ২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মারিয়া। এরপর বরগুনা সরকারি কলেজ থেকে আনার্স সম্পন্ন করেন তিনি। আর সজীবও পাথরঘাটার একটি স্কুল ও একটি কলেজ থেকে ২০১৮ সালে এসএসসি ও ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এ বিষয়ে পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান ফাতিমা পারভীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বামীহারা ফাহিমা বেগম তার ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে জেলেপল্লীতে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাই আমরা তাকে জয়িতা সম্মাননা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি।
আরএআর