নিজের মতো হতে দিতে চান না সন্তানকে
ম্যাসে রান্না করছেন সেলিনা
অভাবের সংসারে চেনা গ্রাম ছেড়ে অচেনা শহরে এসে অন্যের বাড়িতে থেকে ভিক্ষা করে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেন সেলিনা বেগম। অন্ধকার ভবিষ্যৎ আলোকিত করতে বিভিন্ন বাড়িতে নারীদের কাছে শরণাপন্ন হন সংগ্রামী নারী সেলিনা বেগম। দু-দুবার সংসার ভাঙে তার। কিছুদিন দুশ্চিন্তায় কাটলেও দেখা হয় হামদর্দ লিমিটেডে চাকরি করে এমন এক কর্মকর্তার সঙ্গে। সেখান থেকেই বদলে যায় তার জীবন।
১৫০ টাকা বেতনে শুরু হয় তার নতুন জীবন। হামদর্দ অফিসের কাজের রাঁধুনি হিসেবে। এখানে থেকেই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন সেলিনা। নিজে কষ্ট করলেও সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান তিনি। সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চান তিনি। সন্তানদের মানুষ করা ও দুবেলা আহার জোগাতে কাজ করতে হয়েছে বিভিন্ন ম্যাসে ও বাড়িতে। তবে জীবনের বেশি সময় তিনি রান্না করেছেন শিক্ষার্থীদের (হোস্টেল) ম্যাচে।
বিজ্ঞাপন
ম্যাসের শিক্ষার্থীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয় না সেলিনা বেগমের ভাগ্যের। কিন্তু তাই বলে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি তিনি। বিরামহীন চালিয়ে যাচ্ছেন সংগ্রাম, সন্তানদের পড়ালেখা। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও সন্তানদের স্বপ্নপূরণে নিরলস প্রচেষ্টা সেলিনা বেগমের।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একবুক স্বপ্ন নিয়ে শহরে আসেন সেলিনা বেগম। কান্না আসে আসুক, কিন্তু স্বপ্ন ভেস্তে যেতে দেবেন না তিনি। এ আশা বুকে নিয়ে চলছে তার জীবনযুদ্ধ।
বিজ্ঞাপন
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বাসিন্দা স্বামীকে হারিয়ে চোখে যখন অন্ধকার দেখেন সেলিনা, তখন বাঁচার জন্য এদিক-সেদিক ছোটেন। বাচ্চার মুখে খাবার দিতে নেমে পড়েন রাস্তায়। কিন্তু কেউ সাহায্য করেনি। নতুন করে বাঁচতে ছুটে আসেন ব্যস্ত শহর ভোলায়।
সেলিনা বেগম বলেন, নদীতে যখন বাড়ি ভাইঙ্গা নিছে, থাকার জায়গা ছিল না। মানুষ কইছে শহরে যাইতে। বাড়িতে কিছু না কইয়া ভোলা আইছি ২৮ টাকা বাস ভাড়া নিয়া। বাসের ব্যাডাগোরে কইয়া আমি মাগনা আইছি। ভোলা নামাইয়া দিছে। আমি ভাবছিলাম ভোলা কী রকম জানি। কিন্তু আইয়া দেহি বাসস্টান্ড অল্প কয়ডা দোকানপাট। পরে অটোতে কইরা বাচ্চা লইয়া ভোলা সদরে আইছি। এক মহিলা তার ঘরে আমার জায়গা দেন। রাতে তার বাসায় ছিলাম। দিনে মানুষের থেকে ভিক্ষা করে টাকা নিয়ে খাইছি।
অশ্রুসিক্ত চোখ মুছতে মুছতে সেলিনা তার কষ্টের কথা জানান, দিনে ভিক্ষা করেছেন, রাতে একজনের আশ্রয়ে ছিলেন। এক অফিসে ১৫০ টাকা বেতনে চাকরি পেয়ে জীবনের চাকা সচল হয়। ভালো ব্যবহার আর কাজ দেখে মালিক পক্ষ ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা করেন বেতন সেলিনার। এক কাপড়ে দেখে তাকে একটি কাপড় ও কিনে দেন।
মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে থাকা, বাসন মাজা, পানি আনা, ঘর মোছা― এসব ছিল তার কাজ। নতুন জীবনের শুরুতেই আবার বিয়ে করেন সেলিনা। নতুন সংসারের বছর ঘুরতেই পরিবারে আসে আরেক মেয়েসন্তান। কিন্তু নদীর কূল আর নারী কপালের একই দশা। মেয়ে হওয়ার কিছুদিন পরেই নতুন সংসারটিও ভেঙে যায়। সেলিনার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে অন্য জায়গায় বিয়ে করেন। হার না-মানা সেলিনা এবার আর পেছনে ফিরে তাকাননি।
বিভিন্ন কলেজের ম্যাসে (হোস্টেল) রান্নার কাজ শুরু করেন। সেই টাকা দিয়ে সংসার চালিয়ে বড় মেয়ে রাজিয়া আক্তার মুক্তাকে কলেজে ও ছোট মেয়ে ময়মুনা আক্তার মালাকে স্কুলে পড়ান। বড় মেয়ে মুক্তা আলতাজের রহমান কলেজে অনার্সে পড়তেন। করোনা মহামারি ও লেখাপড়ার খরচ না দিতে পেরে পড়াশোনা এখন বন্ধ করে দিয়েছেন। আর ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া মালাকে যতই কষ্ট করেই হোক পড়াতে চান সেলিনা বেগম।
সেলিনা আরও বলেন, আমি বুড়া হইয়া গেছি। আমার জীবন শেষ পর্যায়ে। যে কয়দিন বাঁচি, কাজকাম করুম। মাইয়া দুইডারে পড়াশোনা করাইয়া ভালো জায়গায় নিমু। আমি কাজের বুয়া ছিলাম। আমার মাইয়ারা যেন বুয়া না হয়। সেলিনা স্বপ্ন দেখেন তার দুই মেয়ে চিকিৎসক-ইঞ্জিনিয়ার হবে। সেই স্বপ্ন বুকে নিয়েই রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন সেলিনা।
ভাগ্যের নিয়তি সেলিনাদের ম্যাসে নিয়ে আসে রান্না করে খাওয়ানোর জন্য। অথচ ম্যাসে থেকে যারা পড়াশোনা শেষ করেন, সেই ম্যাচের শিক্ষার্থীরা হয়তো ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, পুলিশ বা সরকারি বিভিন্ন দফতরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন, কিন্তু সেই সেলিনাদের খবর কেউ রাখেন না।
আক্ষেপ করে সেলিনা বেগম বলেন, আগুনের ধারে থাইকা কত কষ্ট কইরা মায়ের মতো রাইন্ধা মেসের ছেলে-মেয়েদের খাওয়াইছি, বড় হইয়া চাকরি পাইয়া আমাদের সবাই ভুইল্লা যায়।
স্বামীর সংসার হারিয়ে ভেঙে পড়েননি সেলিনা। নিজের মা আর দুই মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট একটি ঘরে থাকেন সেলিনা। এখন স্বপ্ন একটাই, যদি দুই মেয়েকে ভালো একটি জায়গায় চাকরি করতে দেখতে পেতেন।
এনএ