তাম্রবর্ণ পাচ্ছে ল্যাংড়া, বারি-৪ মিলবে সারা বছর
আমের মুকুলে বারি-৪ আমের গবেষণা চলছে
আমের রাজা ল্যাংড়া। স্বাদ ও গন্ধে অদ্বিতীয় এই আম পাওয়া যায় মৌসুমের শুরুতেই। আমের জনপদ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ ছাড়িয়ে ল্যাংড়ার বিস্তৃতি এখন দেশজুড়েই। সুমিষ্ট ল্যাংড়া এবার রঙিন হচ্ছে। সম্প্রতি অনুমোদন পাওয়া বারি-১৪ জাতের আমের গাঢ় তাম্রবর্ণ বা জমাটে লাল বর্ণ পাচ্ছে ল্যাংড়া।
এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। বারি-৪ আম বছরজুড়ে ফলানোর গবেষণাও চলছে একই সঙ্গে। কাটিমন জাতের আমের সংকরায়ণে আসবে আমের নতুন এই জাত। তবে এখনই নয়, নতুন এই দুটি আমের জাত পেতে অন্তত সাত বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে আমচাষি ও বাগানমালিকদের।
বিজ্ঞাপন
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে নতুন আমের জাত উদ্ভাবনে শুরু হয়েছে গবেষণা। এতে অংশ নিচ্ছেন ফল গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী হাসান ওয়ালিউল্লাহ ও ড. জিএম মোরশেদুল বারী ডলার।
ফল গবেষণা কেন্দ্র জানাচ্ছে, বারি-১৪ আমের জাতটি গত ৩১ ডিসেম্বর অনুমোদন পেয়েছে। এটি মূলত সৌদি আরব থেকে আনা। এই জাতের আম পাকলে গাঢ় তাম্রবর্ণ বা লাল বর্ণ ধারণ করে। আকর্ষণীয় রঙের কারণে আমের রাজ্যে বারি আম-১৪ অদ্বিতীয়। ১০ বছরের গবেষণায় আমের এ জাতটি উদ্ভাবন করেছেন রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞাপন
ফল গবেষক ড. জি এম মোরশেদুল বারী ডলার বলেন, তাদের লক্ষ্য বারি-১৪ আমের আকর্ষণীয় রং প্রচলিত ল্যাংড়া আমে আনা। প্রতিবছর ল্যাংড়ার ফলন পাওয়া যায় না। এক বছর পরপর গাছে ল্যাংড়ার মুকুল আসে। তবে বারি-১৪ আমের সঙ্গে সংকরায়ণের ফলে প্রতিবছরই ফল আসবে। দেশে প্রথম সংকর জাতের আম বারি-৪।
দেশি নাবি জাত আশ্বিনার সঙ্গে রঙিন আমের সংকরায়ণে নতুন এই জাতের উদ্ভব হয় ১৯৯৩ সালে। এই জাতটি আনা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে। মৌসুমের শেষ আম হিসেবে আশ্বিনার পর পরিপক্ব হয় উচ্চফলনশীল জাতের এই আম। এরই মধ্যে আমের রাজধানী রাজশাহী অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে বারি-৪ জাতের আম। কাঁচা অবস্থায় টক না থাকায় কাঁচামিঠা আমের মতো খাওয়া যায় এই আম। পাকলে বারি-৪ আম হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় রঙের। কিন্তু বছরে একবারই ধরে বারি-৪।
ড. জি এম মোরশেদুল বারী জানান, তারা সারা বছর বারি-৪ আম ফলাতে চাইছেন। এদিকে বছরে তিনবার ধরে কাটিমন আম। কাটিমনের এ বৈশিষ্ট্যটি বারি-৪ জাতের ভেতরে আনা হবে। কাটিমন জাতের সংকরায়ণে আসা নতুন আমের জাতটি বছরজুড়েই ফলন দেবে। কিন্তু তাতে বারি-৪ আমের সব বৈশিষ্ট্য থাকবে।
নতুন জাত উদ্ভাবন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। ধাপে ধাপে এই প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়। প্রতিটি ধাপের অর্জন নথিভুক্ত করতে হয়। এ নিয়ে বিশদ গবেষণাও চলছে। টানা সাত থেকে দশ বছর পর আসে এমন সাফল্য। নতুন দুটি আমের জাত পেতে অন্তত সাত বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে সরেজমিন দেখা যায়, মুকুলের ভারে নুয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের আমবাগানগুলো। চারদিকে মধুর ঘ্রাণ, ভ্রমরের ওড়াউড়ি ও গুঞ্জন। গত জানুয়ারির শেষ ভাগ থেকেই শুরু হয়েছে মুকুল আসা। এখন মুকুলে ভরে আছে গাছগুলো। প্রতিটি বাগানে আমচাষি ও বাগানমালিকরা পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দফতরের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় প্রতিবছরই বাড়ছে আমবাগান। বাণিজ্যিক আমবাগান গড়ে উঠছে বিশেষ করে নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে। কেবল আমবাগান নয়, বেড়েছে আম উৎপাদনও।
আঞ্চলিক কৃষি দফতরের হিসাবে, এ বছর (২০১৯-২০) রাজশাহী অঞ্চলে মোট আমবাগান রয়েছে ৮১ হাজার ১৫ হেক্টর। এর মধ্যে রাজশাহীতে ১৭ হাজার ৬৮৬, নওগাঁয় ২৪ হাজার ৭৭৫, নাটোরে ৫ হাজার ৫১৯ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৩ হাজার ৩৫ হেক্টর।
এর আগে ২০১৭-১৮ কৃষিবর্ষে এই অঞ্চলে আমবাগান ছিল ৭০ হাজার ৩৪৬ হেক্টর। তা থেকে আম উৎপাদিত হয় ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৩৬১ টন। ২০১১-১২ কৃষিবর্ষে রাজশাহী অঞ্চলে আমবাগান ছিল ৪২ হাজার ৪১৭ হেক্টর। সেবার আম উৎপাদিত হয় ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩ টন।
২০১২-১৩ কৃষিবর্ষে ৪৮ হাজার ৬১০ হেক্টর বাগানে উৎপাদিত হয় ৬ লাখ ১ হাজার ১৩৪ টন আম। ২০১৩-১৪ কৃষিবর্ষে আমবাগান বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ হাজার ৮৯১ হেক্টর। উৎপাদন বেড়ে ওই বছর দাঁড়ায় ৫ লাখ ৩৯ হাজার ২৫৫ টন। ২০১৪-১৫ কৃষিবর্ষে ৫৪ হাজার ৭২২ হেক্টর বাগানে আম উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৯৩৬ টন।
২০১৫-১৬ কৃষিবর্ষে ৫৭ হাজার ৮৬৪ হেক্টর বাগানে উৎপাদন হয় ৬ লাখ ৪২ হাজার ১৮৩ টন আম। এ ছাড়া ২০১৬-১৭ কৃষিবর্ষে ৬৬ হাজার ৩০০ হেক্টর আম-বাগান থেকে ৭ লাখ ৫৬ হাজার ৮৪৯ টন আম উৎপাদিত হয়।
এনএ