শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দান

শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি জয়পুরহাটের অনেকেই। জেলায় সর্বস্বীকৃত শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দান। সেখানে সরকারি-বেসরকারি, জাতীয়, স্থানীয় বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোথাও নেই তাদের নাম বা পরিচয়। এদিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, সংগঠক ও বুদ্ধিজীবী হয়েও স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধাসহ জয়পুরহাটের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।

শহীদ ডা. আবুল কাশেম। জয়পুরহাট শহরের দেবীপুর এলাকায় বসবাস করতেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বুদ্ধিজীবী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই রাতে রাজাকারা তার পুরো বাড়ি ঘেরাও করে। প্রথমে তার বড় ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। রাজাকাররা তাকে দিয়েই তার বাবাকে ডেকে তোলে। পরে তার ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং বিভিন্ন স্থানে নিয়ে নির্যাতন করে মারধর করে।

২৫ জুলাই রাজাকাররা শহীদ ডা. আবুল কাশেমকে আবদুল আলিমের গদি ঘরে নিয়ে যায়। তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তার পরিবার টাকা, সোনাগয়না দিয়েও লাভ হয়নি। পরে গদি ঘর থেকে রেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে তার হাত-পা বেঁধে, গাছে টাঙিয়ে চোখ, হাতের নখ ও সোনা দিয়ে মোড়ানো সব দাঁত তুলে নেয় রাজাকার ও হানাদাররা। নির্যাতনের একপর্যায়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে সদরের কুঠিবাড়ি ব্রিজের নিচে নদীতে ফেলে দিয়ে যায়।

ঢাকা পোস্টের কাছে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবার স্মৃতিচারণা করলেন শহীদ ডা. আবুল কাশেমের মেয়ে লাইলী বেগম।

শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দান

একইভাবে সদর উপজেলার দোগাছীর শহীদ ইয়াকুব আলী মন্ডলকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের দল করার কারণে পাকিস্তানি সেনারা নির্মম নির্যাতন করে। তাদের জিপের পেছনে দড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে টেনে প্রায় ১৭ কিলোমিটার পথ ঘুরে ভারত সীমান্ত সদরের চকবরকত পাগলা দেওয়ান এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় এভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে অনেক শহীদকে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে মেলেনি তাদের স্বীকৃতি। অনেক শহীদের পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। এমনকি শহীদের কবরগুলো সরকারিভাবে সংস্কার করা হয়নি।

জয়পুরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ১০ জন ও সশস্ত্র বাহিনীর ছয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামের একটি স্মৃতিতালিকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে নাম নেই স্থানীয়ভাবে স্বীকৃত শহীদ ডা. আবুল কাশেম ও শহীদ ইয়াকুব আলী মন্ডলের।

শহীদ ডা. আবুল কাশেমের নাতির ছেলে কাজী আসাদুজ্জামান জয় তার বড়বাবার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলেন, কিন্তু আজও মেলেনি স্বীকৃতি। এমন অভিযোগ অনেক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের। আবুল কাশেমের মেয়ে লাইলী বেগম বলেন, এত কিছু হওয়ার পরও আমরা আমার বাবার শহীদের স্বীকৃতি পাইনি। সরকারের কাছে আমার বাবার শহীদের মর্যাদা চাই, এটাই আমার দাবি।

শহীদ ইয়াকুব আলী মন্ডলের নাতি আরিফুর রহমান রকেট ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা আমার দাদাকে বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে প্রায় ১৭ কিমি দূরে চকবরকতের পাগলা দেওয়ান এলাকায় নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তিনি সেই সময় শহীদ হয়েছেন। সেই সঙ্গে এই জেলার অনেকেই শহীদ হয়েছেন, যার তালিকা এখনো হয়নি। আমি মনে করি এ জেলায় যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের একটি তালিকা হওয়া দরকার। তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম তাদের সম্মান করবে, শ্রদ্ধা জানাবে।

সাংস্কৃতিক কর্মী টপি এনামুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, জাতীয়ভাবে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে যে অনুষ্ঠান হয়, তা সব শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দানে হয়। কিন্তু জয়পুরহাটের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা আছে, সেখানে তার কোনো নাম নেই। এটা আমাদের বড় একটা দুর্বলতা। যারা এই দায়িত্বে আছে, তাদের আমি অনুরোধ করব, আবুল কাশেম ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবী। ১৯৭১ সালে তাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাকে তার মর্যাদা দেওয়া হোক।

জয়পুরহাটের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা

জয়পুরহাট সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের সঙ্গে থেকে অনেকে যুদ্ধ করেছেন। অথচ তারা আজও স্বীকৃতি পাননি। যেমন আমাদের শহীদ ডা. আবুল কাশেম। তিনি ওই সময় সরকারি ডিগ্রি কলেজে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। পরে তাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গিয়ে অস্বাভাবিক অত্যাচার ও হত্যা করে লাশ কুটিবাড়ী ব্রিজের নিচে নদীতে ফেলে দেয়। তারপর সাবেক সংসদ সদস্য আব্বাস আলী মন্ডলের বাবা ইয়াকুব আলী মন্ডলকে ধরে নিয়ে গাড়ির পেছনে বেঁধে পাগলা দেওয়ানে নিয়ে হত্যা করে। এভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীরা বাঙালিদের হত্যা করেছে। কিন্তু এসব শহীদদ আজও স্বীকৃতি পাননি। অথচ তারা দেশ ও জাতির জন্য জীবন দিয়েছেন। তাদের স্বীকৃতি পাওয়ার দরকার।

জয়পুরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহীদ ডা. আবুল কাশেমের নামে জয়পুরহাটে ময়দান আছে। ঠিক এ রকমভাবে দোগাছীতে শহীদ সেকেন্দার, যার নামে একটি স্কুল আছে। আমি যদি একজন মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে মুক্তিযোদ্ধা চেতনার পক্ষের মানুষও হই, তবু আমি অন্তস্তল থেকে দাবি করব, এবার অন্তত এই মানুষগুলোর শহীদ হিসেবে মূল্যায়ন হোক।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউপি) মিল্টন চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহীদদের সংখ্যা অনেক হতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে আমরা স্থানীয়ভাবে অবশ্যই সহযোগিতা করব। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করব।

এনএ