‘স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় হলে মুদি দোকানি বাবার দুঃখ ঘোচাবে’
রফিকুল-নাদিরা দম্পতির একমাত্র ছেলে নাফিস ফুয়াদ। কলেজ পড়ুয়া নাফিস (১৮) তাদের ছোট সন্তান। ছেলে বড় হলে মুদি দোকানি বাবার দুঃখ ঘোচাবে এই স্বপ্ন ছিল তাদের।
উপার্জনের টাকায় কোনোরকম সংসার চাললেও ছেলের লেখাপড়ার খরচ নিয়ে কখনো কার্পণ্য করেননি রফিকুল ও নাদিরা। সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সড়ক দুর্ঘটনায় সেই ছেলেকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় বাবা-মা।
বিজ্ঞাপন
সোমবার বেলা ১১টার দিকে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল পৌরশহরের মালীপাড়ায় ট্রাক-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে অটোরিকশার চালকসহ যে পাঁচজন নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে মুদি দোকানি রফিকুল ইসলামের একমাত্র ছেলে নাফিস ফুয়াদও রয়েছেন।
নিহত নাফিস ২০২১ সালে জয়পুরহাট সরকারি রামদেও বাজলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল। তিনি ক্ষেতলাল সরকারি আলতাফুন্নেছা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। এইচএসসিতে ভালো করার আশায় সে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
নাফিস ফুয়াদের বাড়ি ওই উপজেলার শাখারুঞ্জ চৌধুরীপাড়া গ্রামে। সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে বাবা রফিকুল ইসলাম বিলাপ করছিলেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ। নাফিসের মাও কান্না করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছেন। ছেলের অকাল মৃত্যুতে পুরো গ্রামে এখন শোকের মাতম।
নাফিস ফুয়াদের মা বিলাপ করতে করতে বলেন, 'আজকে সকাল ১০টায় আমাকে মোবাইলে কল দিয়ে বলল, মা আমি বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি কোনো চিন্তা কোইরো না। কিছুক্ষণ পর শুনলাম আমার বুকের মানিক নেই। ম্যানষে কয় ছলডা এতো ভদ্র। মোর ছল আর নাই রে।'
নাফিউস ফুয়াদের বাবা রফিকুল মৃধা কাঁদতে-কাঁদতে বলেন, ছেলে আমার লেখাপাড়ায় বেশ ভালো ছিল। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ভালো কলেজে ভর্তির চেষ্টাও করে। ভালো রেজাল্ট করার জন্য কোচিং করছে। সে একটিও টাকা বেশি নিত না। ওকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। লেখাপড়া শেষ করে সংসারের হাল ধরবে। বাবার পাশে দাঁড়াবে। এই দুর্ঘটনা ছেলেটাকে কেড়ে নিল রে।
নাফিসের বোন নদী আক্তার বলেন, আমার ভাই ২০২১ সালে জয়পুরহাট সরকারি রামদেও বাজলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল। ক্ষেতলাল সরকারি আলতাফুন্নেছা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। সে এবার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। সে রাজশাহীতে কোচিং করার জন্য গিয়েছিল। আজ বাড়ি আসার কথা, এজন্য আমি স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে এসেছি। ভাই বলেছিল, বাড়ি গিয়ে একটি বাটন মোবাইল কিনবে। সে বাটন মোবাইল নেবে আর তার টাচ মোবাইল আমাকে দেবে। কিন্তু আজ আমার ভাই আর নেই।
ক্ষেতলাল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাজিবুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার পর ট্রাকচালক পালিয়ে গেছে। ট্রাক ও অটোরিকশা থানা হেফাজতে রয়েছে। আর নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নূরে আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এ ঘটনায় নিহত অটোরিকশার চালক আমাজাদ হোসেনের ছেলে আব্দুল্লাহ আল রিফাত বাদী হয়ে সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করেছেন।
ট্রাক-সিএনজিচালত অটোরিকশার সংঘর্ষের এই দুর্ঘটনায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। নাফিস ছাড়া নিহত অন্যরা হলেন- ক্ষেতলালের ইটাখোলা এলাকার রইচ উদ্দিনের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন (৪৫), ক্ষেতলালের নাসিরপুর পূর্বপাড়া জামে মসজিদের ইমাম সিরাজুল ইসলাম (৬০), সিএনজির ড্রাইভার আমজাদ হোসেন (৫৫) ও জয়পুরহাট শহরের বুলুপাড়া এলাকার বাসিন্দা শাহিনুর বেগম (৩৮)। এ ঘটনায় গুরুতর আহত ক্ষেতলাল উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা লায়লা জাহান নাসরিনকে (৪৮) জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে ক্ষেতলাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুসরাত জাহান বন্যা জানিয়েছেন।
চম্পক কুমার/আরকে