ঋতুরাজ বসন্তে নবযৌবনের সাজে সাজতে শুরু করেছে প্রকৃতি। প্রকৃতির এই লাল রঙে রাঙিয়ে গেছে চারপাশ। লাল আভায় রঙিন হয়ে সৃষ্টি হয়েছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের। এই বসন্তে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের শিমুলবাগানে জমেছে প্রাণের মেলা। গাছে গাছে থোকায় থোকায় রক্তরাঙা শিমুল ফুল, পাখপাখালিদের কলকাকলিতে মুখরিত পরিবেশ। সকল বয়সী মানুষের পদচারণায় নবপ্রাণের সঞ্চার হয়েছে এখানে।

একটু স্বস্তির আশায় পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব মিলে হেসেখেলে, আড্ডায় শিমুল বাগানে সময় পার করেছেন ভ্রমণ পিপাসুরা। সকল কর্মব্যস্ততা ভুলে কিছু সময় প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে আনন্দ উপভোগ করতে দেশসহ প্রবাসের অনেকেই ছুটে আসছেন শিমুলবাগানে।

সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী উপজেলা তাহিরপুর। উপজেলার লাউড়েরগড় এলাকার একপাশে মেঘালয় পাহাড়। অন্যপাশে এশিয়ার সর্ববৃহৎ শিমুল বাগান। তার মাঝে বুক চিড়ে বয়ে গেছে অপরূপা যাদুকাটা নদী। বছরের এই সময়ে মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়, যাদুকাটার নীল পানি,  শিমুলের টকটকে লাল ফুল, সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয় নয়নাভিরাম অপরূপ এক সৌন্দর্যের।

২০০৩ সালে জয়নাল আবেদীন নামের এক ব্যক্তি যাদুকাটা নদীর পশ্চিম তীরে মানিগাঁও গ্রামে ৩৩ একর জমিতে প্রায় ৩ হাজার শিমুল গাছ রোপণ করেন। গাছগুলো বড় হওয়ায় এখন সব গাছেই ফুল ফুটেছে। শিমুল বাগান দেখতে প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে লোকজন আসছেন। প্রথমে শুধু তুলা সংগ্রহের জন্য গাছ লাগানো হলেও এখন পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন শুধু ফুল ফোটার সময়ই নয়, সারা বছর শিমুলবাগানে আসেন পর্যটকরা। জয়নাল আবেদীন মারা যাওয়ার পর তার সন্তানরা এই বাগানের দেখভাল করছেন।

শিমুল ফুলের কোনো বিশেষ গন্ধ না থাকলেও এর সৌরভ ছড়াচ্ছে চারদিকে। আর এই সৌরভ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রবাসীদেরও আকৃষ্ট করছে। আর তাইতো শিমুলবাগানের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ছুটে আসছেন। যারাই এসেছেন সবাই সন্তুষ্ট হচ্ছেন। তারা বলছেন, শিমুল বাগানে না এলে এর সৌন্দর্য বুঝার মতো না।

সিলেট থেকে আসা শিশু সালেহা জানায়, মা-বাবার কাছ থেকে শিমুলবাগানের নাম শুনেছে। শিমুল বাগানে এসে ঘোড়ায় চড়ে বেশ আনন্দ পেয়েছে।

নেত্রকোণার কমলাকান্দা থেকে আসা বিনীতা হাজং বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিমুল বাগানের কথা শুনে এসেছি। কিন্তু আসার সৌভাগ্য হয়নি। এবার পরিবার নিয়ে এসেছি। এসে খুবই ভালো লেগেছে। চারদিকে শুধু লাল আর লাল। না এলে এর সৌন্দর্য বুঝার মতো না।

দর্শনার্থী পলি রায় বলেন, শিমুলবাগানে একেক সময়ে একেক রকম সৌন্দর্য দেখা যায়। বর্ষাকালে চারপাশ সবুজ থাকে আর বসন্তে ফুল ফুটে আগুন ঝড়ে। মেঘালয় পাহাড়, যাদুকাটা নদী তার পাশে শিমুলবাগান। সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ।

তবে এখন শিমুলবাগান শুধুই নিছক সৌন্দর্যের জন্য উপভোগ্য নয়। বাগানের ফলে কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয়দের। প্রতিদিন ঘুরতে আসা মানুষকে সঙ্গ দিয়ে, ছবি তুলে, ফুলের মালা বিক্রি করে, ঘোড়ায় চড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে অন্তত একশ পরিবার।

ফুলবিক্রেতা রায়হান বলে, প্রতিদিন এখানে ফুল কুড়াই। ফুল দিয়ে মালা তৈরি করে বিক্রি করে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পাই। তা নিয়ে পরিবারে দিই।

বাগানমালিক প্রয়াত জয়নাল আবেদীনের ছেলে নুর উদ্দিন ইসলাম বলেন, আমার বাবা শখের বশে ৩৩ একর জমিতে প্রায় তিন হাজার শিমুল গাছের চারা রোপণ করেন। এখন চারাগুলো বড় হয়েছে। সব গাছেই ফুল ফুটে। শিমুল বাগান দেখতে দেশ-বিদেশের লোকজন ছুটে আসে। শুধু ফুল ফোটার সময়ই নয়, বর্ষাকালসহ এখন সারা বছরই এখানে পর্যটকরা আসেন।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বললেন, শিমুলবাগান সুনামগঞ্জের পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে একটি। দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ শিমুলবাগান এটি। বছরের এই সময়ে অপরূপ সৌন্দর্য ধারণ করে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকরা শিমুলবাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন। জেলা প্রশাসন থেকে শিমুলবাগানসহ সুনামগঞ্জের সকল পর্যটন স্পটের পরিচয় তুলে ধরতে নানা ধরনের প্রচার-প্রচারণা করা হয়ে থাকে।

সোহানুর রহমান সোহান/এমজেইউ