স্থানীয় প্রভাবশালী দালালদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নেত্রকোণা সার্কেল অফিস। দালালদের দ্বারস্থ না হলে কোনো সেবা মিলছে না। তারা সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। দালাল ছাড়া কাজ করতে গেলে পড়তে হচ্ছে নানা বিড়ম্বনায়। ঘুরতে হচ্ছে মাসের পর মাস।

গতকাল রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত নেত্রকোণা বিআরটিএ অফিস প্রাঙ্গণে অবস্থান করে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপ দিতে এসেছেন কলমাকান্দা উপজেলার খারনৈ ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা রবিকুল ইসলাম (৪০) ও সিফাত উল্লাহ (২০)। তারা জানান, ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিন মাস আগে স্থানীয় দালাল কামরুলের সঙ্গে লাইসেন্সের জন্য জনপ্রতি আট হাজার ৫০০ টাকা করে চুক্তি করেন। এখানে দালাল ছাড়া কোনো কাজ হয় না। টাকা কিছু বেশি নিলেও দালাল দিয়ে কাজ করানো সহজ। দালালরা সব দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে দেন।

সদর উপজেলার কাইলাটি গ্রামের যুবক তাজবীর (৩৫)। রোববার দুপুরে তিনি বিআরটিএ অফিসে স্থানীয় আনারুল নামের এক দালালের মাধ্যমে ছোট ভাইয়ের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন। কথা হলে তাজবীর বলেন, দালাল না ধরলে এখানে কোনো কাজ হবে না। ১২ হাজার টাকা দিয়ে চুক্তি করে আজ আবেদন করেছি।

নেত্রকোণার ফকিরের বাজারের পাচপাই আনন্দবাজার এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (৩০) লাইসেন্সের জন্য কাজ করিয়েছেন শো-রুমের মাধ্যমে। এজন্য ওই শো-রুমকে দিতে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া গ্রামের বাসিন্দা আমিন খান (২৮) স্থানীয় ইয়ামাহা শো-রুম এবং কেন্দুয়া উপজেলার সাউদপাড়া এলাকার বাসিন্দা হাফিজুর রহমান স্থানীয় আইমান শো-রুমের মাধ্যমে ১৬ হাজার টাকায় লাইসেন্সের কাজ করিয়েছেন বলে জানান

একই উপজেলার চল্লিশা গ্রামের বাসিন্দা উৎপল ঘোষ (৩২) জানান, তিনি আজ প্রথমবারের মতো বিআরটিএ অফিসে লাইসেন্সের জন্য এসেই দালালের খপ্পরে পড়েন। তারা কাগজপত্র দেখে প্রথমে বলেন, এসব কাগজ দিয়ে লাইসেন্স হবে না। পরে তার কাগজপত্র নিয়ে বাইরে দাঁড় করিয়ে দালালরা অফিসের ভেতরে যান। বেরিয়ে এসে বলেন, টাকা দিলে কাজটা করে দিতে পারবেন।

এদিকে, নেত্রকোণার ফকিরের বাজারের পাঁচপাই আনন্দবাজার এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (৩০) লাইসেন্সের জন্য কাজ করিয়েছেন গাড়ির শো-রুমের মাধ্যমে। এজন্য ওই শো-রুমকে দিতে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া গ্রামের বাসিন্দা আমিন খান (২৮) স্থানীয় ইয়ামাহা শো-রুম এবং কেন্দুয়া উপজেলার সাউদপাড়া এলাকার বাসিন্দা হাফিজুর রহমান স্থানীয় আইমান শো-রুমের মাধ্যমে ১৬ হাজার টাকায় লাইসেন্সের কাজ করিয়েছেন বলে জানান।

‘শো-রুমের মাধ্যমে কাজ করাতে গিয়ে কিছু টাকা বেশি লাগলেও তাদের তেমন কোনো ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। দুই মাসের মধ্যেই তাদের লাইসেন্সের কাজ মোটামুটি হয়ে গেছে’— দাবি করেন তারা।

তবে, কোনো পরীক্ষা না দিয়েই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে বিআরটিএ অফিসে আঙ্গুলের ছাপ দিয়েছেন আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান গ্রামের বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম (২৬)। তিনি বলেন, ‘দালালদের সঙ্গে চুক্তি করলে পরীক্ষা না দিলেও পাস করা যায়। তারাই সব করে দেয়।’

এখানে কীভাবে লাইসেন্সের আবেদন করা যায়— জানতে চাইলে স্মার্টকার্ড নিতে আসা জেলা সদরের চল্লিশা ইউনিয়নের ছনুরা গ্রামের মাজহারুল ইসলাম (৪০) নামের এক ব্যক্তি বিআরটিএ অফিস সংলগ্ন মূল সড়কের পাশে থাকা স্থানীয় দালাল সোহাগের ‘বিসমিল্লাহ কম্পিউটার অ্যান্ড ফটোস্ট্যাট’ নামের দোকানে নিয়ে যান। তবে, সোহাগকে দোকানে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল নম্বর দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন তিনি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে থাকা প্রায় প্রতিটি কম্পিউটার দোকানের লোকজন বিআরটিএ অফিসের দালালির সঙ্গে জড়িত।

জেলার পূর্বধলা উপজেলার হোগলা ইউনিয়নের শ্যাওলা গ্রামের গিয়াস উদ্দিন (৫০)। পেশায় ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালক। তিনি বলেন, ‘২০২১ সালে আমি লাইসেন্সের জন্য সাড়ে আট হাজার টাকায় চুক্তি করে দালালের মাধ্যমে আবেদন করি। করোনার কারণে এতদিন লাইসেন্স হয়নি। আজ ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়েছি।’

‘এখানে দালাল না ধরলে পরীক্ষায় কেউ পাস করতে পারেন না। আর দালাল ধরলে রক্তের গ্রুপও পরীক্ষা করতে হয় না। সব তারাই করে দেয়।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নেত্রকোণা বিআরটিএ অফিসে কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ জন দালাল কাজ করেন। তারা সবাই স্থানীয়। স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি, সরকার দলীয় নেতা ও শ্রমিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে তারা দাপটের সঙ্গে দালালি করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- কামরুল, নভেল, আনারুল, শরীফ, সোহাগ, আলমগীর, মিলন ও জীবন। এছাড়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের আবুলসহ অনেক কর্মচারী এর সঙ্গে জড়িত। তাদের যোগসাজশ রয়েছে বিআরটিএ অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে।

দালালদের সঙ্গে চুক্তি করলে সেবাপ্রত্যাশীদের সময় মতো আসা-যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে হয় না। পরীক্ষায় শুধু উপস্থিত হলেই সবাইকে পাস করিয়ে দিতে পারেন তারা। আবার পরীক্ষা না দিলেও পাস করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এমনকি অষ্টম শ্রেণির ভুয়া সনদপত্রও বানিয়ে দেন তারা। তিন মাসের মধ্যেই সব কাজ শেষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দালালের এক সহকর্মী জানান, তাদের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পর আবেদনকারীকে আর কিছুই করতে হয় না। শুধু চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিলেই হয়। পরীক্ষায় পাস করানোর জন্য অফিসের লোকজনকে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা করে দিতে হয়।

সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে মোটরসাইকেলের লাইসেন্স করার জন্য স্থানীয় দালাল কামরুলের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, মোটরসাইকেলের লাইসেন্স করতে চাইলে মোট সাড়ে আট হাজার টাকা লাগবে। ‘আমি তো গাড়ি চালাতে জানি না, এমনকি পড়াশোনাও জানি না। আমার লাইসেন্স কি করে দিতে পারবেন’— এমন প্রশ্নে ওই দালাল বলেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। সব আমি ব্যবস্থা করে দেব’

সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে মোটরসাইকেলের লাইসেন্স করার জন্য স্থানীয় দালাল কামরুলের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, মোটরসাইকেলের লাইসেন্স করতে চাইলে মোট সাড়ে আট হাজার টাকা লাগবে। ‘আমি তো গাড়ি চালাতে জানি না, এমনকি পড়াশোনাও জানি না।  আমার লাইসেন্স কি করে দিতে পারবেন’— এমন প্রশ্নে ওই দালাল বলেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। সব আমি ব্যবস্থা করে দেব।’

এসব অনিয়মের বিষয়ে কথা হয় নেত্রকোণা বিআরটিএ সার্কেলের সহকারী পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মোটর পরিদর্শক কেশব কুমার দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, দালালির সঙ্গে জড়িত এমন কেউই আমার অফিসে নেই। যদি এমন হয় তবে আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আমার অফিসের দরজা সেবাপ্রত্যাশীদের জন্য সবসময়ই খোলা।

‘বেশ কিছুদিন আগে চারজন দালালকে আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিয়েছি। আমার অফিসে বর্তমানে দালালদের কোনো স্থান নেই। আর পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স পাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। তবে, অফিসের বাইরে কোনো দোকানে যদি দালাল থাকে সেক্ষেত্রে আমার করার কিছু নেই।’

জেলায় মোট মোটরযানের সংখ্যা কত এবং এর বিপরীতে কতটি লাইসেন্স আছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, সত্যি বলতে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। অনলাইন হওয়ায় সব হেড অফিসে আছে। তবে, আনুমানিক জেলায় ২৩ হাজারের মতো লাইসেন্সপ্রাপ্ত মোটরসাইকেল, ৮৭০টির মতো সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ৯৭টির মতো প্রাইভেট কার, ১০৫টির মতো ট্রাক রয়েছে। কিন্তু লাইসেন্স নেই এমন মোটরযানের সংখ্যাটা সঠিক বলতে পারব না। সংখ্যা অনেক বেশি হবে। সময় দিলে সাত দিনের মধ্যে এসব পরিসংখ্যান খুঁজে বের করে দিতে পারবেন বলে জানান তিনি।

এ সময় ভিডিও বক্তব্য চাইলে তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলে দিতে হবে। এছাড়া দেওয়া যাবে না।’

এমজেইউ