আব্দুর রাজ্জাক, ছিলেন স্কুলশিক্ষক। সেখান থেকে বনে যান কক্সবাজার বিআরটিএ অফিসের শীর্ষ দালাল। লাইসেন্স বা এ সংক্রান্ত কোনো কাজই রাজ্জাকের হাত ছাড়া হয় না। তিনি এখানকার অলিখিত সম্রাট। তার প্রতিটি ফাইলে দেওয়া থাকে বিশেষ চিহ্ন। যা দেখে বিআরটিএ কর্মকর্তারা নিমিষেই সই করে দেন।

সরেজমিনে কক্সবাজার বিআরটিএ সার্কেল অফিস ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া যায়। ঢাকা পোস্টের কাছে কক্সবাজার বিআরটিএ অফিসের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। তাদেরই একজন মোহাম্মদ শুক্কুর। জানান, দালাল রাজ্জাকের মাধ্যমে লাইসেন্স করতে দিয়েছেন উখিয়া-টেকনাফের অন্তত ৩৫ জন সিএনজি অটোরিকশার চালক। তিনিও তাদের একজন।

‘কয়েক দফা টাকা নেওয়ার পরও রাজ্জাক দালাল লাইসেন্স দেয়নি। ছয় মাসের বেশি সময় পার হয়েছে। এখনও লাইসেন্স হাতে পাইনি। বিআরটিএ কর্তাদের হাত করে ফাইলটিও মিলছে না। এদিকে, লাইসেন্স না থাকায় গাড়িও চালাতে পারছি না।’

এস আলম পরিবহনের গাড়িচালক ফারুক। বাড়ি পেকুয়ার টৈটং ইউনিয়নে। বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় গত বছরের ২৩ মার্চ ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে দেন এই অফিসের সালেহ নামের এক কর্মকর্তাকে। এক বছর আগে আবেদন করেছেন। ২০ হাজার টাকাও দিতে হয়েছে ওই কর্মকর্তাকে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখনও হাতে পাননি লাইসেন্স। বিআরটিএ কার্যালয়ে ধরনা দিয়েছেন ৩৪ বার। তাতেও মন গলেনি কর্মকর্তাদের। উত্তর একটাই, ‘পরে আসুন, এখনও প্রক্রিয়াধীন’।

বিআরটিএ কক্সবাজার সার্কেল অফিসের সামনে কান্নারত অবস্থায় তিনি জানান, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় ট্র্যাফিক পুলিশ তাকে ২০টি মামলা দিয়েছে। লাইসেন্স সঙ্গে না থাকায় এস আলম পরিবহনের চাকরিও গেছে। লাইসেন্স নবায়ন করতে গিয়ে আজ পথে বসার অবস্থা তার। 

আরেক ভুক্তভোগী টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনছিপ্রাং গ্রামের মোহাম্মদ আলী। তিনি জানান, ড্রাইভিং ভিসায় সৌদি আরব যাওয়ার জন্য মায়ের স্বর্ণ বিক্রি করে তিন লাখ টাকা জোগাড় করেছেন। এক বছর আগে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন। বিআরটিএ কার্যালয়ে গেছেন অনেকবার। পরীক্ষাও দিয়েছেন দুবার। এখনও হাতে পাননি কাঙ্ক্ষিত লাইসেন্স। এদিকে, ড্রাইভিং লাইসেন্স হাতে পাওয়ার আগেই তার ভিসার মেয়াদ শেষ!

‘আমি ও আমার গ্রামের আরেকজন একসঙ্গে আবেদন করেছিলাম। তিনি জিকু নামের এক দালালকে ১৬ হাজার টাকা দিয়ে তিন মাসের মধ্যে লাইসেন্স পেয়েছেন। টাকা না দেওয়ায় আমার লাইসেন্স হলো না।’

কক্সবাজার পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাইদুর রহমান শিমুল। বলেন, মোটরসাইকেলের মালিকানা পরিবর্তনের জন্য পাঁচ মাস আগে কাগজ জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনও হাতে পাইনি। কর্মকর্তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখান। পাঁচ দিনের মধ্যে কাজ করে দেবেন জানিয়ে এক কর্মকর্তা ছয় হাজার টাকা দাবি করেছেন।

টেকনাফ মৌলভীবাজার এলাকার সিএনজি অটোরিকশার চালক কফিল উদ্দিন। বলেন, নয় মাস আগে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করি। পরীক্ষার জন্য ডেকেছিল। এ সময় এক কর্মকর্তা টাকার কথা বলেন, আমি দিইনি। পরীক্ষা ঠিকঠাক দিলেও টাকা না দেওয়ায় উত্তীর্ণ করেনি। পরে রাজ্জাক নামের এক দালালকে ছয় হাজার টাকা দিয়েছি। তিনিও আজ হবে, কাল হবে বলে ঘুরাচ্ছেন।

চকরিয়া চিরিংগ্যা এলাকার মামুন বলেন, দালালের সঙ্গে চুক্তি করলে সহজেই লাইসেন্স পাওয়া যায়। চুক্তি ছাড়া বিআরটিএ অফিসে দুই বছর ঘুরেও লাভ নেই। এটি পুরোপুরি দালাল চক্রের নিয়ন্ত্রণে।

টেকনাফের উনছিপ্রাংয়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ ফায়সাল বলেন, মোটরসাইকেলের নম্বরের জন্য আবেদন করেছিলাম। এত দিন ব্যাংকের স্লিপ দেখিয়ে বাইক চালিয়েছি। ট্র্যাফিক পুলিশ ধরলেও স্লিপ দেখে কিছু বলেনি। আজ গাড়ির স্মার্ট কার্ড হাতে পাব। গতকাল বিআরটিএ অফিস থেকে কল দিয়েছিল। আজ নিতে এলাম।

কত টাকা খরচ হয়েছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুধু ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছি। এর বাইরে কাউকে কোনো টাকা দিতে হয়নি। কারণ, আমি সতর্ক ছিলাম। এখানে যারা দালালের মাধ্যমে কাজ করান তারাই প্রতারণার শিকার হন। যারা সরাসরি বিআরটিএ অফিসে এসে সেবা নিচ্ছেন তারা সঠিক সেবা পাচ্ছেন।

কক্সবাজার পৌরসভার ১২নং ওয়ার্ডের তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বেশি টাকায় বেশি সেবা, কম টাকায় কম সেবা। সত্য কথা বললে আমার লাইসেন্সও হারাতে হবে।’

এসব হয়রানির বিষয়ে জানতে কক্সবাজার বিআরটিএ সার্কেলের সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেনের কক্ষে গেলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

এদিকে গাড়িচালকদের অভিযোগ, কিছু কিছু মানুষ লাইসেন্স জাল করছে। এখন পুলিশ কাগজপত্র না দেখে ৫০০ টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে যে টাকা আয় হয় তা ট্র্যাফিক পুলিশের পকেটে চলে যায়। এমন হয়রানি থেকে মুক্তি চান তারা।

ওএফ/