যে বয়সে তার সহপাঠীদের সঙ্গে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, যে বয়সে লেখাপড়ার টেবিলে নির্ঘুম রাত কাটানোর কথা, যে বয়সে স্বপ্ন দেখবেন ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার, সে বয়সে তাকে ভাবতে হচ্ছে বেঁচে থাকা না-থাকা নিয়ে। পিতৃহারা জান্নাতুল ফেরদৌস আঁখি (১৭)। তার দুটি কিডনিই বিকল। চিকিৎসকদের পরামর্শ, কিডনি প্রতিস্থাপন করা খুব জরুরি।

এদিকে দিন যত যাচ্ছে, আঁখির শারীরিক অবস্থার ততই অবনতি হচ্ছে। তাই এখন একমাত্র ভরসা সরকারি ও বিত্তবানদের আর্থিক সহায়তা। অর্থাভাবে মেয়ের ডায়ালাইসিস করাতে পারছে না দরিদ্র পরিবারটি। এমন অবস্থায় চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অসহায় পরিবারটি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, সহপাঠীরা।

জান্নাতুল ফেরদৌস আঁখি আলিম দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। মা ও চার বোনের সংসার তাদের। মেধাবী এই শিক্ষার্থীর আজ দুটি কিডনিই বিকল। আঁখি বাগেরহাটের ফকিরহাট খানজাহানপুর মোহাম্মাদিয়া সিনিয়র আলিম মাদরাসার আলিম দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছয় মাস আগে আঁখির জীবনে এসেছিল সবচেয়ে বড় আঘাত। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন তার বাবা। মা ও চার বোনের সংসারে জান্নাতুল ফেরদৌস আঁখি সবার ছোট। তাই একটু বেশিই আদরের। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ১৭ বছর বয়সী এই তরুণী।

যখন হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস চলছিল

বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের উতকুল গ্রামের মৃত আবুল শেখ ও মর্জিনা বেগম দম্পতির ছোট মেয়ে আঁখি অনেক দিন ধরে অসুস্থ। তার বাবা আবুল শেখ বেঁচে থাকতে নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়েছিলেন। তখন মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন আঁখি। কিন্তু মরণব্যাধি ক্যানসারে তার বাবার মৃত্যুর পর তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। সংসার চালাতেই যেখানে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে উন্নত চিকিৎসা তো দুঃসাধ্য। আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসীর সহায়তায় কিছুদিন চিকিৎসা চললেও এখন অর্থের অভাবে তা বন্ধ।

দুটি কিডনিই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া বেঁচে থাকার আর কোনো উপায় নেই জান্নাতুলের। আত্মীয়দের মধ্যে একজন কিডনি দিতে রাজি হলেও প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দরিদ্র পরিবারটির পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তাই মেয়েকে বাঁচাতে সমাজের বিত্তবানদের প্রতি সাহায্যের আবেদন জানান আঁখির মা মর্জিনা বেগম।

ঢাকা পোস্টকে জান্নাতুল ফেরদৌস আঁখি বলেন, আমি অনেক দিন ধরে অসুস্থ। দুটি কিডনিতেই সমস্যা। আমার এখন হাঁটতে গেলে, খেতে গেলে সমস্যা হয়। আমি ঠিকমতো কিছুই করতে পারি না। আমি সুস্থ হয়ে আবার আমার মাদরাসায় ফিরে যেতে চাই। পড়ালেখা শেষ করে মানুষের জন্য ভালো কিছু করার জন্য বেঁচে থাকতে চাই।

আঁখির বসতবাড়ি

প্রতিবেশী শেখ লুৎফর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে আঁখিকে চিকিৎসার জন্য সাহায্য করছি। তার বাবা মারা যাওয়ার পরে এলাকাবাসীর সহায়তায় ঢাকা ও খুলনার বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে গেছি। শহীদ শেখ আবু নাসের হাসপাতালে বেশ কয়েকবার ডায়ালাইসিস করানো হয়েছে। কিন্তু এখন তার অর্থনৈতিক অবস্থা এত খারাপ যে পরবর্তী চিকিৎসা চালানো আর সম্ভব হচ্ছে না। একটি জীবন যেন অকালে ঝরে না যায়, সে জন্য সরকারি ও বিত্তশালীদের প্রতি সাহায্যের অনুরোধ জানান তিনি।

স্থানীয় মোল্লা মারুফ বলেন, আঁখি আমাদের চোখের সামনে ছোট থেকে বড় হয়েছে। কিন্তু এখন অসুস্থ হয়ে ক্রমাগত তার শরীর অবনতির দিকে যাচ্ছে। অর্থের অভাবে চিকিৎসাও বন্ধ প্রায়। কোনো রকম এলাকাবাসী ও আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় ওষুধ কেনা হচ্ছে।

আঁখির সহপাঠী বৃষ্টি খাতুন বলেন, আমি আর আঁখি একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। খেলাধুলা, ঘুরে বেড়ানো, মাদরাসায় যাওয়া― সবকিছুই একসঙ্গে করতাম। আঁখি আজ বাইরে বের হতে পারছে না। আমি চাই আঁখি যেন ভালো চিকিৎসার মাধ্যমে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। আমরা আবার একসঙ্গে মাদরাসায় যেতে চাই।

খানজাহানপুর মোহাম্মাদীয়া সিনিয়র আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ মো. আবু বক্কর সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আঁখির পরিবার খুবই দরিদ্র। আমরা মাদরাসার পক্ষ থেকে কিছু সাহায্য করেছি। তবে উন্নত চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। এই ব্যয় বহন তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করছি এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, সে যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।

তানজীম আহমেদ/এনএ