নদীর প্রশস্ততার জন্য ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ, উল্টো কমেছে
পাড়ের মাটি আবারও নদীতেই পড়ছে
রংপুরের পীরগাছায় মাষাণকুড়া নদীর পুনঃখননকাজে নয়ছয় করার অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের দায়সারা কাজ আর অপরিকল্পিত খননে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে যাচ্ছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, পুনঃখননকাজ শেষে পুরো প্রকল্প মূল্যায়ন করে দেখা হবে। কোথাও অনিয়ম হলে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
অভিযোগ উঠেছে, মাছ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে মাষাণকুড়া নদীর পুনঃখননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে বরাদ্দ ধরা হয় প্রায় ৬৬ লাখ টাকা। অথচ দায়সারা খননে নদীর প্রশস্ততা বাড়ার বদলে উল্টো কমেছে। সঙ্গে অপরিকল্পিত খননের কারণে সামনের বর্ষা মৌসুমে নদীর দুই পাড়ের মাটি পড়ে মাষাণকুড়ার তলদেশ আবার ভরাট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
মাষাণকুড়া একসময় শাখা নদী ছিল। সময়ের পরিক্রমায় মাটি ভরাট আর দখলদারদের কারণে নদীটি সংকুচিত হয়েছে। নদী পরিণত হয়েছে খালে। অথচ এই মরা নদী পীরগাছা উপজেলার একমাত্র মাছের অভয়াশ্রম। এখানে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছ উৎপাদিত হয়। জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের (দ্বিতীয় সংশোধিত) আওতায় নদী পুনঃখননকাজ চলছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পীরগাছা উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের মরানদী মাষাণকুড়ার প্রায় দেড় কিলোমিটারজুড়ে পুনঃখননকাজ চলছে। একটি সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে প্রকল্প এলাকায়। তবে জনসমাগম নেই, এমন স্থানে ঝুলে থাকা সাইনবোর্ডটি নিয়েও স্থানীয়দের মাঝে রয়েছে ক্ষোভ। নদী থেকে খালে পরিণত মাষাণকুড়ার চারটি অংশ ভাগ করে প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু একটি অংশেই কাজের তথ্য দিয়ে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। বাকি তিন অংশে কোনো সাইনবোর্ড নেই, প্রকল্পের কোনো তথ্যও নেই।
বিজ্ঞাপন
গত ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মাষাণকুড়া মরানদীর পুনঃখননকাজ। প্রকল্পের কাজ এ বছরের ৩১ মার্চ শেষ করার সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। বাস্তবায়নে প্রকল্পটি চারটি অংশে ভাগ করা হয়― প্রথম অংশে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় অংশে ১৯ লাখ ২০ হাজার, তৃতীয় অংশে ১৩ লাখ ১০ হাজার ও চতুর্থ অংশে ১৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে বরাদ্দ ৬৬ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।
ইতোমধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ অংশের কাজ শেষ হয়েছে। গভীরতার কারণে দ্বিতীয় অংশটির কাজ শুরু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে প্রথম অংশের কাজ শেষের দিকে।
স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুল হকের সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুনেছি ৬৬ লাখ টাকার বেশি বরাদ্দ হয়েছে মরানদীর খননকাজ। অথচ প্রকল্পের লোকেরা প্রচার করছে সরকার নাকি নামমাত্র টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এত টাকা দিয়ে যদি দেড় কিলোমিটারেরও কম আয়তনের মাষাণকুড়া সঠিকভাবে পুনঃখনন না হয়, তাহলে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। এখন প্রকল্পের লোকজন অর্থ বরাদ্দ নিয়ে চলছে লুকোচুরি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার মাছের অভয়াশ্রম বাঁচাতে এবং দেশীয় মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে লাখ লাখ টাকার কাজ হচ্ছে, অথচ দায়সারাভাবে কাজ চলছে। কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে নদী থেকে মাটি তুলে তা ফেলে রাখা হচ্ছে নদীর পাড়ে। এতে নদীর প্রশস্ততা বাড়ার বদলে উল্টো কমেছে।
স্থানীয়রা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ঝড়-বৃষ্টির দিন এলে মাটি ধসে আবার নদীতে গিয়ে পড়বে। এভাবে কাজ করে লাভ কী? শুধু শুধু সরকারের টাকা নষ্ট।
প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশে খননকাজ হয়নি। কিন্তু ওই অংশের কাজের বিল উত্তোলন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন কৃষক আফতাব মিয়া। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাষাণকুড়ার মূল অংশটি এখনো খনন করা হয়নি। মাছের অভয়াশ্রম অংশটিতে পানির পরিমাণ বেশি এবং গভীরতাও অনেক। সারা বছরই সেখানে পানি থাকে। এই অংশ খননের জন্য ১৯ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ আছে। কিন্তু গভীরতার কারণে তলদেশ খনন করা হয়নি। এখন শুনছি প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশের ৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকার বিল তুলে নেওয়া হয়েছে। এভাবে কাজ না করে যদি টাকা তোলা যায়, তাহলে তো কাজে অনিয়ম দুর্নীতি হবে। আমরা চাই সরকারি কাজ যাতে দায়সারা না হয়।
মাষাণকুড়া নদীর পাড়ের বাসিন্দা ময়না বেগম বলেন, জীবনে তো অনেক নদী খোঁড়া দেকনু। কিন্তু পরে ফির যেই নদী সেই থাকে। এত খুঁড়িয়াও কোনো লাভ হয় না। মাষাণকুড়াতো মরানদী। সেই তকনে এটা আরও ভালো করি খোঁড়া উচিত। সারা বছর মাছ ধরা যায়। যদি সরকারের লোকেরা ভালো করি নদী খোঁড়ে, সরকারের সুমান হইবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই বলেন, এই প্রকল্পের চারটি অংশের মধ্যে দ্বিতীয় অংশটি গভীরতার কারণে খনন করার সুযোগ নেই।শুধু তা-ই নয়, ভেকু দিয়ে দায়সারাভাবে খননকাজ করা হচ্ছে। এখানে শ্রমিক ব্যবহার করা হচ্ছে না। ভেকুচালকরা নিজেরাই কাজ করছেন। কীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে, তাও কেউ জানে না। যেভাবে কাজ হয়েছে, এতে মোট বরাদ্দের অর্ধেক টাকাও খরচ হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাষাণকুড়া মরানদী পুনঃখনন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রতি অংশে ৩০ জন করে সুবিধাভোগী কাজ করবেন। এ জন্য চারটি অংশের জন্য ১২০ জনের দল গঠন করা হয়েছে। তবে এই দল গঠন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। প্রকল্পের সম্পূর্ণ কাজটি করছে জেলা মৎস্য কর্মকর্তার যোগসাজশে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল।
অনিয়মের মাধ্যমে কাজ চলছে স্বীকার করে স্থানীয় মৎস্যজীবী সমিতি ও প্রকল্পের চতুর্থ অংশের সভাপতি প্রেমা চন্দ্র দাস বলেন, আমরা কাগজে-কলমে থাকলেও কাজটি করছে অন্যরা। আমরা গরিব মানুষ, এ রকম বড় প্রকল্পের কাজ করার সুযোগ কি আমাদের হয়? তা ছাড়া এসব বিষয়ে কথা বললেও তো সমস্যা আছে। এ জন্য আমরা চুপ আছি বলেও জানান তিনি।
প্রকল্প এলাকায় টানানো সাইনবোর্ডের তথ্য অনুয়াযী উপজেলা মৎস্য দফতর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তবে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হাকিবুর রহমান এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই প্রকল্পটি জেলা অফিস থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যদিও আমি বেশ কয়েকবার প্রকল্প এলাকা পরির্দশন করেছি। তবে এ ব্যাপারে আমি বিস্তারিত কিছু বলতে পারব না।
স্থানীয়দের অভিযোগের ব্যাপারে রংপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বরুণ চন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখনো তো পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। চারটি অংশের কাজ শেষ হওয়ার পর পুরো প্রকল্পটি মূল্যায়ন করে দেখা হবে। তার আগেও তো বলা যাচ্ছে না এটা দায়সারা কাজ। তবে একটি সাইনবোর্ডে আমিও দেখেছি।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এনএ