তানিয়া আক্তার

পারিবারিক টানাপোড়েন ও অসচ্ছলতার কারণে বেশি দূর লেখাপড়ার সৌভাগ্য হয়নি তার। অষ্টম শ্রেণিতে উঠতেই শ্বশুরবাড়ির জোয়াল কাঁধে তুলে দেয় পরিবার। স্বপ্নহীন হয়ে পড়েন তিনি। তখন থেকেই শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। পার হয় বিবাহিত জীবনের ছয়টি বছর। কিন্তু অভাব আর দূর হয় না তানিয়া আক্তারের।

অনেক কষ্টে কিনে ফেলেন একটি পুরোনো সেলাই মেশিন। বাড়িতেই শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। পার্শ্ববর্তী এলাকার পোশাক কর্মীসহ বিভিন্ন মানুষের কাপড় আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পরিচিতি। দেখতে থাকেন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। তারপর একদিন কেনেন বৈদ্যুতিক সেলাই মেশিন। সেই থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তানিয়ার।

আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের তাজপুর এলাকার ইয়াকুব আলীর ছেলে সোহেল মৃধার (৩২) সঙ্গে ২০০৮ সালে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় ধামরাইয়ের ছয়বাড়িয়া এলাকার মৃত সোবহান ব্যাপারীর মেয়ে তানিয়ার। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ায় সংসার বুঝতেও লেগেছে দীর্ঘ সময়। এমন সময়ে দুই সন্তানের জননী হন তিনি। স্বামী বেকার বলে নিজের ও সন্তানের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য মুখ চেয়ে বসে থাকতে হতো শ্বশুরবাড়ির লোকজনের প্রতি। কিন্তু তানিয়ার তা ভালো লাগত না। চেষ্টা শুরু করেন কিছু একটা করার।

ঢাকা পোস্টকে তানিয়া তার পথচলার কথা বলেন, খুব কম বয়সেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী (সোহেল মৃধা) বেকার ছিল। কোনো কাজও করত না সে। আমার প্রসাধনসামগ্রী-কাপড়সহ ভরণপোষণ করতেন আমার শ্বশুর। এ রকম নির্ভরশীল জীবন কারোরই ভালো লাগে না। আমরাও কষ্ট হতো। কিন্তু আমার স্বামী বুঝত না। পরে আমি অনেক কষ্টে একটা পুরোনো সেলাই মেশিন কিনে গার্মেন্টস কর্মীদের থ্রি-পিস সেলাই করা শুরু করি। নিজের খরচ চালিয়ে অল্প করে সঞ্চয় করতে থাকি। সংসারের সব কাজ করে রাতে সেলাই করি। দীর্ঘদিন এভাবে করার পর জমানো কিছু টাকা দিয়ে পাইকারি দোকান থেকে থ্রি-পিস কিনে বাসাতেই রাখি। কেউ কাপড় সেলাই করতে এসে পছন্দ হলে সেলাই করার অর্ডার দিতেন।

এভাবে ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়ে তানিয়ার। তার ব্যবসার প্রসার হতে থাকে। পরে স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে বাসার পাশেই ২০২০ সালের জানুয়ারিতে একটি দোকান নেন। দোকান নেওয়ার পর থেকে টুকটাক সহযোগিতা করতে থাকেন তার স্বামী। তখনো তার স্বামী তার শ্বশুরের ওপর নির্ভরশীল।

তানিয়া বলেন, আয় বাড়তে থাকলে স্বামীকেও ব্যবসায়ে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। দোকানের মালামাল কেনার সময় সঙ্গে স্বামীকেও নিয়ে যেতাম। তারপর সেও দোকানে বসা শুরু করে। স্বামীর জন্য কিছু করার চিন্তা আসে মাথায়। ঋণ নিয়ে ২০২০ সালের অক্টোবরে পাইকারি কাপড়ের মার্কেটে বিট (দোকান) নিয়ে দিই। এরপর থেকে সপ্তাহে দুই দিন মার্কেটের পাইকারি কাপড়ের হাটে ব্যবসা শুরু করে সে। এখন সব মিলিয়ে আমার মাসিক আয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।

প্রথম থেকেই তানিয়ার কাছে কাপড় সেলাই করেন পোশাককর্মী আকলিমা। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, অল্প সময়ের মধ্যেই দোকান, পাইকারি দোকান, অনলাইনে কাপড় বিক্রি করে অনেক দূর এগিয়েছেন তানিয়া। চোখের সামনেই সফল মানুষে পরিণত হলেন তিনি। আমরাও সব সময় তার কাছেই কাপড় কিনে সেলাই করে নিই। অনেক ভালো থ্রি-পিস ও ভালো সেলাই করেন তিনি। আজ তার কাছে আমাদের মতো নারীর অনেক কিছু শেখার আছে। তার সব সময় মঙ্গল কামনা করি।

তানিয়ার স্বামী সোহেল মৃধা ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটা চাকরি করতাম। চাকরি ছেড়ে আবার বাবার বোঝা হয়ে যাই। আমি বেকার ছিলাম, কোনো কাজ করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। প্রথমে আমি তেমন গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু তানিয়ার একার চেষ্টায় আজকের এই প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলে আমাকেও কর্মের সুযোগ করে দিয়েছে সে। আমি তাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছি এখন। এসব কাজে আমার বাবা কোনো রকম বাধাও দিতেন না। বরং উৎসাহিত করতেন। তানিয়ার চেষ্টায় আজ একটি খুচরা কাপড়ের দোকান, পাইকারি দোকান ও 'সিনহা ফ্যাশন' অনলাইন শপের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে। এখানে আমারসহ কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে আরও একজনের। আজ প্রতি মাসে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয়ের কারিগর তানিয়া।

তানিয়ার শ্বশুর ইয়াকুব আলী বলেন, আমার ছেলে কষ্টের কোনো কাজ করতে পারত না। বাধ্য হয়েই তার সন্তান ও পুরো পরিবারের খরচ চালাতে হতো। নিজে কিছু করা চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই ছিল তানিয়ার। আমি কখনো বাধা দিতাম না। তার কাজে সব সময় উৎসাহ দিতাম। অনেক কষ্ট ও ধৈর্যের ফসল হিসেবে আজ তারা স্বাবলম্বী। তাদের জন্য সব সময় দোয়া করি। তাদের ব্যবসার আরও প্রসার হোক। পাশাপাশি যে কেউ বুদ্ধি খাটিয়ে একটু কাজ করলেই সফল উদ্যোক্তা হতে পারেন। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমার পুত্রবধূ তানিয়া।

তানিয়া বলেন, পরিশ্রম আর একাগ্রতা নিয়ে লেগে থাকলে যেকোনো কাজে সফলতা আসবেই। আমি প্রথম থেকেই কিছু একটা করার চেষ্টায় থাকায় আজ সফলতা পেয়েছি। পরনির্ভরশীল হতে হয় না এখন আর।

এনএ