একমুঠো খাবারের অপেক্ষায় তারা
মানিকগঞ্জে প্রতিদিন খাবার দিয়ে অসহায়দের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে সেবাতরী ফাউন্ডেশন
‘আগে দুপুরে কিনা (কিনে) খাইতাম, এখন কিনা খাওয়া লাগে না। প্রতিদিন দুপুরে আমাগো খাবার দেয়। একদিন ডাল-ভাত দেয়, আবার কোনো দিন খিচুরি, বিরিয়ানিও দেয়। টেকা দিয়া কিনা খাইতাম, এহন ওই টেকা বাঁচতাছে। দুপুরে খাইতে গেলে ৫০ টাকা লাগে। এই টাকা দিয়া বাড়িতে অন্য সদাই নিয়া বউ পোলাপান মিলা খাই। প্রতিদিনই এই খাবারের অপেক্ষায় থাকি।’
কথাগুলো বলছিলেন মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকার ভিক্ষুক মন্টু খাঁ। তার বাড়ি সদর উপজেলার মুলজান গ্রামে। ভিক্ষুক মন্টু খাঁর মতো আরও ২৫ থেকে ৩০ জন ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী ও পথচারী প্রতিদিন দুপুরে এই খাবার পান।
বিজ্ঞাপন
করোনাকালীন এসব মানুষের খাবার সংকটের চিত্র দেখে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বিনামূল্যে একবেলা খাবার বিতরণের কার্যক্রম শুরু করে মানিকগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেবাতরী ফাউন্ডেশন’। কার্যক্রমের নাম দেওয়া হয় ‘একমুঠো খাবার’।
সেবাতরী ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, করোনাকালীন মানিকগঞ্জের দিনমুজর, ভিক্ষুক, পথচারী, প্রতিবন্ধী ও নিম্নআয়ের মানুষের একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। তখন প্রতিদিন ১০০ জন মানুষের মাঝে এই খাবার বিতরণ করতেন ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবী ১৫ জন কর্মী। এই কার্যক্রম এখনও চলমান রয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন দুপুরে ২৫ থেকে ৩০ জনকে বিনামূল্যে এই খাবার বিতরণ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। খাবার বিতরণে প্রতিদিন কাজ করেন ৮ জন কর্মী।
বিজ্ঞাপন
সংগঠন সূত্রে আরও জানা যায়, লকডাউনের সময় জেলার বেউথা বস্তি, নয়াকান্দি, কুশেরচর, জয়রা, বাসস্ট্যান্ড এলাকা, জাগীর, তরাসহ বিভিন্ন উপজেলায় হ্যালোবাইক নিয়ে ঘুরে ঘুরে এই খাবার বিতরণ করা হয়। ১০০ জনের খাবার কার্যক্রম চলে ২০২০ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। পরে লকডাউন থেকে মুক্ত হয়ে মানিকগঞ্জের করোনা পরিস্থিত উন্নতি হলে সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ থেকে ৩০ জনকে বিনামূল্য খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
সংগঠনের কর্মী ফারাবি রহমান বাঁধন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক বছর ধরেই বিনামূল্যে একবেলা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। করোনাকালীন ও বন্যার সময় প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জনকে এই খাবার দেওয়া হতো। এখন মানিকগঞ্জ জেলা শহর, বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যেসব প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক রয়েছে; যারা হাঁটাচলা বা কোথাও গিয়ে খেতে পারেন না, এমন ৩০ জনকে প্রতিদিন দুপুরে খাবার দিয়ে থাকি।
তিনি বলেন, ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে যখন খাবার নিয়ে যাই তখন তারা মন থেকে যে হাসিটা দেয় বা দোয়া করে, এটি আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। আর এই অনুভূতিটাও আমার অনেক ভালো লাগে।
সদর উপজেলার মত্ত এলাকার মনিরুজ্জামান মনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৩ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় দুটি পা, হাত ও কোমড়ে আঘাত পাই। অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারিনি। যে কারণে কোনো কাজ করতে পারি না। স্ত্রী ও ২ ছেলে-মেয়ের ভরণপোষণ করার জন্য বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছি।
তিনি বলেন, প্রতিদিন দুপুরে এই ভাইয়েরা খাবার দেয়। এতে আমার অনেক উপকার হচ্ছে। দুপুরে খাইতেও ৫০ থেকে ৬০ টাকা লাগে। এই টাকা আমার খরচ করা লাগে না। এতে মাসে ১৫০০ টাকা আমার জমে। আর এই টাকা দিয়ে আমি স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ের পেছনে খরচ করতে পারি।
পাবনার বেড়া উপজেলার চরশাবুল্লাহ গ্রামের ভিক্ষুক চান্দু শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি এখানে দুই মাস ধরে আইছি। তারা আমাগো প্রতিদিন দুপুরে খাবার দেয়। আমি এই দুই মাস ধরে খাবার পাইতাছি। আমার কোনো বেটা ছাউয়াল (ছেলে) নাই, তিন মেয়ে বিয়ে দিয়া দিছি। বয়সের ভারে ভারী কাজ করতে পারি না বলেই পেটের তাগিদে ভিক্ষা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন খাওন দেয় তাতে আমরা একটু বাঁচি। ডাল ভাত দিখ আর খিচুরি দিখ; যাই দেয় তাতেই মেলা উপকার হইতাছে। এহন দুপুরে তো কিনা খাওয়া লাগে না।’
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার মুলজান এলাকার ভিক্ষুক মন্টু খাঁ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী নই। ১৫ বছর বয়সের সময় আমার পায়ে ব্যথা হয়। সেই ব্যথা এখনও আছে।’
সোহেল হোসেন/এমএসআর