মুক্তিযুদ্ধের আগেই পারিবারিকভাবে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২৫ মার্চের পর সব হিসাবই যেন পাল্টে গেল দেশের মানুষের কাছে। শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছিল তখন। ২৫ মার্চ কালরাতের আগেই ঢাকা ত্যাগ করতে হয়েছিল রমা দাসকে। বীর মুক্তিযোদ্ধা এই দম্পতি এমনটাই জানান। 

মহান মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন ৯ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন বেগের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য বিভাগ থেকে পাস করা রমা রানী দাস একই সেক্টরে নারী মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অধ্যাপক পার্থ সারথী, রমা রানী দাস, মকবুল হোসেন তালুকদার, নীলচাঁদ রাজাসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতির কথা তুলে ধরেছে ঢাকা পোস্ট।

পার্থ সারথী ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি একাত্তরে হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করার পাশাপাশি পাবলিক রিলেশন ও যুদ্ধকালীন ইন্টেলিজেন্সে কাজ করেন; কাজ করেন পলিটিক্যাল মোটিভেটর হিসেবেও। সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের আস্থাভাজন ছিলেন তখন। ক্যাম্প পরিদর্শনে জেনারেল এম এ জি ওসমানী তার প্রিয় হতে পেরেছিলেন বলে জানান পার্থ সারথী।

অন্যদিকে রমা রানী দাস একাত্তরের আগে থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিটিং, মিছিল, দেয়াললিখন, পোস্টার লাগানোসহ রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, মতিয়া চৌধুরী তাদের নেতৃত্বদানকারী অগ্রজ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এ দেশের নারীসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রমা দাস বিভিন্ন কথিকা পাঠ করতেন।

রমা দাসের বাবা ঝালকাঠি পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার ছিলেন। আশু বিপদ টের পেয়ে ঝালকাঠি থেকে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তার বাবা। রমা দাসের ভাইয়ের সঙ্গে পার্থ সারথী ও রমার দুই পরিবার একত্রে চলে যায় স্বরূপকাঠির কামারকাঠি গ্রামে রমার মামার বাড়িতে। নিজ বাড়িতেই থেকে যান পার্থ ও তার মা-বাবা।

পাকিস্তানি হানাদাররা প্রথম যেদিন ঝালকাঠি শহর পুড়িয়ে দেয়, পার্থ সারথী কয়েক কিলোমিটার দূরে লুকিয়ে ছিলেন। রমা দাসের ভাষ্যমতে, শহর পোড়ানোর ধোঁয়া অন্তত সাত-আট কিলোমিটার দূর থেকে স্পষ্ট দেখা গেছে। পার্থ সারথী আধা কিলোমিটার দূর থেকেই নিজেদের বাড়িঘর জ্বলছে দেখে বুঝে ফেলেছেন, তার মা-বাবা আর নেই। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাউকাঠিতে পৌঁছান। কিন্তু সেখানে গিয়ে উভয় পরিবারের সঙ্গে বাবা-মাকেও খুঁজে পান। তখন আবার আনন্দাশ্রু বয়ে যায় সবার মধ্যে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন তালুকদার

পেয়ারা-বাগানের কাছে মাদ্রা ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন বেগের অধীনে পার্থ ও রমা প্রশিক্ষণ নেন। ঝালকাঠি শহর ছাড়ার আগেই অবশ্য পার্থ পার্শ্ববর্তী কীর্ত্তিপাশা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের সঙ্গে সুসম্পর্ক হয় তার। মাদ্রা ক্যাম্প ছেড়ে যখন ক্যাপ্টেন বেগ সুন্দরবন হয়ে ভারতে চলে যান, তখন পার্থকে দুটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও ১০টি গ্রেনেড দিয়ে যান। সেগুলো নিয়ে পার্থ ইন্দুকাঠিতে যুদ্ধে অংশ নেন।

পরে হানাদাররা পেয়ারা-বাগান পুড়িয়ে দেয়। তখন ভারত সীমান্তের দিকে ছুটল দুই পরিবার। বিপদ আর ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হয়তো সীমানা পার হতে পারতেন না, যদি সীমান্ত এলাকার শান্তি কমিটির একজন চেয়ারম্যান সহযোগিতা না করতেন।

রমা দাস বলেন, লোকটি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হলেও সেদিন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা রেখে আমাদের বাঁচিয়েছিলেন।

ভারতে গিয়ে তারা যে যার আত্মীয়র বাড়িতে অবস্থান নেন। অ্যালেঞ্চা ক্যাম্প থেকে শরণার্থীদের নির্ধারিত রেশনও দুবার তুলেছেন পার্থ সারথী। যখন মনে হলো, এটা কোনো জীবন নয়, তখন ৯ নম্বর সেক্টরের টাকি ক্যাম্পে ছুটে যান পার্থ। সেখানে গিয়ে মেজর জলিলের সঙ্গে আবার দেখা করেন।

রমা দাস যে আত্মীয়র বাড়িতে ছিলেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি আন্তরিকতার অভাব দেখতে পান। কারও চোখ লাল হলে বা ‘চোখ উঠলে’ সেখানকার মানুষ বলত চোখে ‘জয়বাংলা’ হয়েছে। কয়েক মাস এগুলো দেখার পর তিনিও টাকি ক্যাম্পে চলে যান। সেখানে ক্যাপ্টেন বেগের সঙ্গে দেখা হয় আবারও। তখন বেগের অনুরোধে প্রায় ৪৫ নারী মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করেন রমা। আর তাদের প্রশিক্ষণ দেন সুবেদার মেজর মাজেদুল হক।

পার্থ সারথী জানান, তিনি ক্যাম্পে যুক্ত হয়েছিলেন জীবনের মায়া ত্যাগ করে। ভেবেছিলেন পরিবারের কারও সঙ্গে আর দেখা হবে না। কিন্তু কয়েক মাস পরই রমা দাসকে ক্যাম্পে দেখতে পান। এরপর দু-একবার তাদের দেখা হয়েছে।

এবিসি টিম একবার তাদের ক্যাম্পে তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছিল। পার্থ পরে তাদের ক্যামেরা বহন করে এগিয়ে দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে দেখতে পেলেন, তারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। পকেট থেকে রিভলবার বের করে দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তে পার্থ তাদের আটক করলেন সব জিনিসপত্রসহ। তাদের ব্যারাকপুর পাঠিয়ে ফিরে এলেন কোয়ার্টারে। এর মধ্যে ফোন এল জেনারেল ওসমানীর। অপর প্রান্ত থেকে জেনারেল বলছিলেন, ‘হোয়ার ইজ বাস্টার্ড, পার্থ সারথী? অ্যারেস্ট হিম ইমেডিয়েটলি।’

জেনারেলের এই কথা মেজর জলিলকে পার্থ জানিয়েই পালালেন। মেজর জানতেন পার্থ কোথায় পালিয়েছেন। এবিসি টিমের লোকদের এরপর ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের আটকের ক্ষমতা আর্মি পার্সনদের মধ্যে শুধু জেনারেল ওসমানীরই ছিল। সেখানে পার্থ একজন সাধারণ যোদ্ধা হয়েও দুঃসাহসিকভাবে নিজের মৃত্যুকেই প্রায় ডেকে এনেছিলেন।

এর আগেও দু-একবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন পার্থ। বিভিন্ন বাংকারে প্যান্টে হাঁটুসমান কাদা নিয়ে যুদ্ধের সময় অতিবাহিত করেছেন পার্থ। পিঠে একটি ব্যাগ আর গায়ে থাকা শার্টটিই ছিল সম্বল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রমা দাস যখন দেশে ফিরছেন, তখন ভয় পাচ্ছিলেন ভেবে, একজন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে সমাজ নানাভাবে মেনে নেয়। তিনি ফিরে আসার সময় এই অঞ্চল থেকে যাওয়া ক্যাম্পের মেয়েদের দায়িত্বের সঙ্গে নিয়ে আসেন। তাদের যার যার বাড়িতে পৌঁছে দেন। ঠিকানা না পেয়ে একজনকে নিজের কাছে রেখে দেন। পরে তাকে বিয়েও দিয়ে দেন। আর পার্থ সারথী দাস ভারতের কালিঘাটে গিয়ে অনাড়ম্বরভাবে রমা রানী দাসকে বিয়ে করেন।

এদিকে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ৬ নম্বর বাসন্ডা ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মকবুল হোসেন তালুকদার যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, তার এক বছরের শিশু ও স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে যান। একসময় বাড়ির মানুষ মনে করেছিল, মকবুল নিশ্চিত শহীদ হয়েছেন। তার স্ত্রীর নাকের ফুল সে সময় সবাই খুলে রাখতে বলেছিল। কিন্তু স্ত্রীর বিশ্বাস ছিল স্বামী মারা যাননি। মানত করেছিলেন, স্বামী যদি জীবিত ফেরেন, তাহলে পশু জবাই করে মানুষকে খাওয়াবেন। পরে একদিন এক সহযোদ্ধার কাছে নিজের শিশুসন্তানের জন্য একটি নতুন জামা ও ভালো থাকার খবর পাঠান মকবুল।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন তালুকদার ঢাকা পোস্টকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারদের ছোড়া একটি গুলি তার আঙুলে লেগেছিল। সেই দাগ এখনো আছে। এখনো আঙুলটি সম্পূর্ণ ভাঁজ করতে পারেন না। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি ফেলে জানান, যুদ্ধকালীন অনেক সময় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আবার রাত থেকে সকাল পর্যন্ত পরিত্যক্ত পুকুরে নেমে লুকিয়ে থাকতেন। এদিকে জোঁক রক্ত খেয়ে শরীর সাদা বানিয়ে ফেলত।

এই যে আমাগো বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাগো খোঁজখবর রাখতে আছে, আল্লাহ তার মনের আশা পূর্ণ করুক, সাফল্যমণ্ডিত করুক, বলেন মকবুল হোসেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নীলচাঁদ রাজা

ঝালকাঠির পশ্চিম চাঁদকাঠি শেখ মুজিব সড়কের বীর মুক্তিযোদ্ধা নীলচাঁদ রাজা যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, তখন তার বাবা হামেদ রাজা বাধ্য হয়ে ছেলেকে আইনিভাবে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন। নতুবা হানাদাররা বাড়ির সবাইকে মেরে ফেলত। নীলচাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, ত্যাজ্য ঘোষণার খবর সে সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নীলচাঁদ পেয়ারা-বাগানের যুদ্ধে অংশ নেন। বিজয়ের অনেক দিন পর তিনি বাড়ি ফেরেন। স্বজনরা ভেবেছিলেন তিনি যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।

সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নীলচাঁদ রাজা বলেন, এই সরকার আমাদের সম্মানজনক ভাতা দিচ্ছে বলে দুটো ডালভাত খেয়ে বেঁচে আছি। এভাবেই যেন সরকার আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের লালনপালন করে যায়।

পার্থ সারথী দাস ঝালকাঠি সরকারি কলেজ থেকে অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যান। রমা রানী দাস অবসরের আগ পর্যন্ত ঝালকাঠি সরকারি হরচন্দ্র বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী দেওয়ার বিষয়ে অধ্যাপক পার্থ সারথী দাস বলেন, এটি আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। এর দ্বারা কার কী উপকার হচ্ছে, জানি না। তবে আমি উপকৃত। শেখ হাসিনা আমাদের সম্মানিত করেছেন। খোদা তাআলা তাকে সম্মানিত ও দীর্ঘায়ু করুক।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রমা রানী দাস বলেন, কিছু পাওয়ার আশায় যুদ্ধে যাইনি। তবে সরকারের দেওয়া ভাতায় আমরা উপকৃত। বৃদ্ধরা এ বয়সে অনেক সমস্যার মধ্যে থাকে। একাত্তরের পর আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কোনো প্রমোশন পাইনি। শেখ হাসিনার সময় আমি ১৫ বছর পর আমার পেনশন ফিরে পেয়েছি। এ রকম আমরা যারা পেনশন সারেন্ডার করেছি, সবাই ফুল পেনশন পাচ্ছি। তাই বলব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন দেশের সেবায় নিজেকে আরও উৎসর্গ করতে পারে।

৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। সব বাবা-মা যেন তাদের সন্তানদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে গল্পাকারে বলে। অথবা সরকার যেন পুঁথিপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের কথা ভালোভাবে যুক্ত করে, যাতে বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম আরও বাড়ে, এমন দাবি করেন রমা রানী দাস।

এনএ