মাইক্রোবাসটি ছিল নতুন, চালকেরও প্রথম যাত্রা
রাজশাহীতে দুর্ঘটনার পর মাইক্রোবাসে আগুন লেগে যায়
রাজশাহীর কাটাখালীতে দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটি ছিল নতুন। কয়েকদিন আগে ওই মাইক্রোবাসটি কেনেন পীরগঞ্জ সদর উপজেলার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। নতুন মাইক্রোবাসে পীরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার ১৭ জন যাত্রীকে নিয়ে রাজশাহীতে যাত্রা করেছিলেন চালক হানিফ হোসেন পচা (২৮)। রাজশাহীর পথে নতুন মাইক্রোবাস নিয়ে এটি ছিল তার প্রথম যাত্রা। কিন্তু দুর্ঘটনার সময় গাড়ি নিয়ে ভুল পথে ছিলেন চালক হানিফ হোসেন।
শুক্রবার (২৬ মার্চ) দুপুর পৌনে ২টার দিকে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের কাটাখালী থানার সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগামী হানিফ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস চলে এলে মাইক্রোবাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ছিটকে গিয়ে বাসটি থানার সামনের মহাসড়ক থেকে নেমে গিয়ে গাছের সঙ্গে আটকে যায়। মাইক্রোবাসটিতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়। এতে মাইক্রোবাসে থাকা ১৮ জনের মধ্যে চালক হানিফ হোসেনসহ ১৭ জন আগুনে পুড়ে মারা যান।
বিজ্ঞাপন
এ দুর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান পাভেল নামে এক তরুণ। বর্তমানে তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার বাবা মোখলেছার (৪৫) ও মা পারভীন (৩৫) আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। তাদের বাড়ি পীরগঞ্জের রায়পুর ইউনিয়নের দ্বাড়িকাপাড়া গ্রামে।
এদিকে দুর্ঘটনার সংবাদ জানাজানির পর থেকে মাইক্রোবাসটির মালিক রফিকুল ইসলাম তার মুঠোফোন বন্ধ করে রেখেছেন। বাসাবাড়ি ও পীরগঞ্জ গোডাউন মোড়ের কাছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়েও তার দেখা পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞাপন
তবে স্থানীয়রা জানান, সপ্তাহখানেক আগে কালো রঙয়ের হাইয়েস মাইক্রোবাসটি (ঢাকা মেট্রো-চ-১৩-৭০৬৬) কেনেন রফিকুল। নতুন ওই গাড়িতে ১৭ জন যাত্রী নিয়ে শুক্রবার ভোর ৬টার দিকে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে প্রথম ভাড়া নিয়ে যান মাইক্রোবাস চালক হানিফ হোসেন পচা। সেখানে শাহ মখদুমের মাজার, পদ্মার পাড়সহ দর্শনীয় বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখার কথা ছিল মাইক্রোবাস আরোহীদের। কিন্তু পথিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় চালকসহ ১৭ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। নিহত মাইক্রোবাস চালক হানিফ হোসেন পচা পীরগঞ্জের থানাপাড়া এলাকার মৃত আঞ্জু মিয়ার ছেলে।
চালক হানিফ হোসেনের ভুলের কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে মনে করছেন রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় মজিদপুর গ্রামের বাসিন্দা বাবুল মিয়া। এই দুর্ঘটনায় রামনাথপুর ইউনিয়নের দুই পরিবারের পাঁচজন করে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বাবুল মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাইক্রোবাস চালক হানিফ আগে স্থানীয় চেয়ারম্যানের ভাইয়ের গাড়ি চালাতেন। বৃহস্পতিবার রাতে নতুন গাড়ির ভাড়ার অফার পেয়ে শুক্রবার ভোরে যাত্রী নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, সিসি টিভির ফুটেজ দেখে মনে হয়েছে মাইক্রোচালক হানিফ ভুল পথে ছিলেন। মাইক্রোবাসটি মহাসড়কের ডানপাশ (ভুল পথে) দিয়ে যাচ্ছিল। ওই সময় বাঁশ নিয়ে যাওয়া একটি ভ্যানকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেন মাইক্রোচালক। একই সময়ে বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগামী হানিফ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস ওই মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দেয়। এতে মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। যদি মাইক্রোচালক ডানদিকে গাড়ির টার্ন না নিতেন, হয়তো দুর্ঘটনাটি ঘটত না। তবে এই দুর্ঘটনার জন্য বেপরোয়া গতিতে বাস চালানো হানিফ পরিবহনের চালকও দায়ী।
বড় রাজারামপুর গ্রামের নুরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ রকম দুর্ঘটনা যে ঘটবে, সেই কথা কি কেউ জানত? কাকে দোষারোপ করব। নতুন মাইক্রোবাস পেয়ে ড্রাইভার হানিফ একটু বাড়তি ভাড়ার আশায় গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন। নতুন গাড়ি নিয়ে রাজশাহীতে হানিফের সেইদিন প্রথম যাত্রা ছিল। কিন্তু এটাই যে সবার শেষ যাত্রা হবে, তাতো জানা ছিল না। একসঙ্গে ১৭ জনের মৃত্যু রংপুরে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ঘটনা।
রাজশাহীর কাটাখালীর মর্মান্তিক ওই সড়ক দুর্ঘটনায় নারী ও শিশুসহ নিহত ১৭ জনই রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। শুক্রবার (২৬ মার্চ) বিকেলে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে দুর্ঘটনার সংবাদ জানার পর থেকে নিহতদের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। স্বজন হারাদের আর্তনাদে গ্রামে গ্রামে শুরু হয় শোকের মাতম। একসঙ্গে এতোগুলো মানুষের মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে পীরগঞ্জ উপজেলা। ঘটনার একদিন পর এখন লাশের অপেক্ষায় রয়েছেন আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীরা।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর