‘ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল মানুষের পাশে দাঁড়াব। কিন্তু আর্থিকভাবে সেই সামর্থ্য না থাকায় মানুষকে তেমন সহযোগিতা করতে পারিনি। ছোটবেলায় দেখতাম গ্রামের কোনো মানুষ যখন মারা যেতেন তখন অনেক মানুষ মিলে তাকে গোসল করাচ্ছেন। ওই সময় আমি মাদরাসার ছাত্র। তখনই ভেবেছি মৃত ব্যক্তির গোসল করানোর মাধ্যমেও মানুষের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব। সেই ইচ্ছা থেকেই মৃত মানুষের গোসল দিয়ে আসছি।’

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিনিধির সঙ্গে এভাবেই জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন শাহজাহান মুন্সি। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডার ইউনিয়নের আদর্শপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান মুন্সি। বর্তমানে সুগন্ধি আতর বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি।

শাহজাহান মুন্সি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ৪৫ বছর ধরে মৃত ব্যক্তিকে গোসল, কাফন ও সুগন্ধি মাখানোর কাজ করছি। এই ৪৫ বছরে অন্তত ৮৩১ জন মৃত ব্যক্তির গোসল ও কাফনের কাপড় পরিয়েছি। অনেক সময় মৃত ব্যক্তির পরিবারের খাটিয়া বহন করারও কেউ থাকে না, তখন গ্রামের কয়েকজন মিলে দাফন করেছি।

প্রায় সহস্রাধিক মানুষের অন্তিম যাত্রায় নিজের সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করেছেন শাহজাহান মুন্সি। নিজে সামর্থ্যবান না হলেও কখনো পিছপা হননি। কীভাবে এসব করতেন, জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমি ভেবেছি অন্যের কাজ করলে আল্লাহ একদিন আমাকে এর প্রতিদান দিবেন। বড় কথা আল্লাহ কখনো ঠেকায় না। তাই এতগুলো বছর ধরে এই কাজ করে আসছি। যখন দেখতাম হাতে টাকা নেই, তখনই কিছু টাকা দিয়ে আতর কিনে বাজারে বিক্রি করতাম। আতর ছাড়াও মসজিদের ইমামতি করেছি। সেখানে টাকা পেতাম। ওই টাকায় আমার পরিবারের ভরণপোষণসহ সুন্দরভাবে নিজের কাজগুলো করতে পারতাম।

শাহজাহান মুন্সি আরও বলেন, যখনই কেউ ফোন দিয়েছে, গভীর রাত হলেও সেখানে ছুটে গিয়েছি। কারও কারও বাড়িতে মৃত ব্যক্তির পাশে সারারাত জেগে থেকেছি। তবে এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছি। মন চাইলেও সব জায়গায় যেতে পারি না। একটি বাইসাইকেল কিনেছি, যা দিয়ে সব জায়গায় চলাফেরা করি।

বর্তমানে শাহজাহান মুন্সির শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। অর্থাভাবে নিজের চিকিৎসাও ঠিকমতো করাতে পারছেন না তিনি। তারপরও কারও কাছে হাত পাততে অনীহা তার। সৃষ্টিকর্তাই তার শেষ ভরসা, এই বিশ্বাস থেকে প্রতিটি নিশ্বাস ফেলে যাচ্ছেন তিনি।

ঢাকা পোস্টের প্রতিনিধির সঙ্গে শাহজাহান মুন্সি 

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে আমার হার্ট ব্লক হয়েছিল। অনেক মানুষ আমার জন্য দোয়া করেছেন। এজন্য আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। মহান আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। দুই হাত তুলে মহান আল্লাহর কাছে সব সময় ক্ষমা চাচ্ছি। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ওষুধ কিনতেই টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবুও কারও কাছে আমি হাত বাড়াইনি। আমার বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা অসুখ দিয়েছেন, তিনিই সুস্থ করে দেবেন।

করোনাকালীন অভিজ্ঞতা

বৈশ্বিক করোনা মহামারির সময়ও থেমে থাকেননি এই বৃদ্ধ। মানুষ যখন ভয়ে দূরে থাকত, আপন মানুষগুলোও যখন পর মানুষের কাতারে চলে গিয়েছিল, তখনও মৃত ব্যক্তির মরদেহ গোসল দিয়েছেন তিনি। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে শাহজাহান মুন্সির দাবি, এক অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে মানুষ কতটা অসহায় ছিল। মনে হয়েছিল পৃথিবীতে কেউ কারও নয়। বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন কেউই তাদের অপন মানুষগুলোকে আগলে রাখতে চাইনি। সেই সময়েও ভয়ভীতি, মৃত্যুর ঝুঁকি সবকিছু উপেক্ষা করে মৃত ব্যক্তির পাশে থেকে গোসল ও দাফন-কাফন সম্পন্ন করেছেন শাহজাহান।

ঢাকা পোস্টকে শাহজাহান মুন্সি বলেন, করোনাকালীন ১৭ জন ব্যক্তির গোসল থেকে শুরু করে সবকিছু আমি করেছি। ওই সময় দেখেছি অনেক আপন মানুষও কাছে আসেনি। আমি অবাক হতাম। কি একটা ভাইরাস, তার আতঙ্কে মানুষের এতদিনের পরিচয়-সম্পর্ক সবকিছুই শেষ, করোনা বড় অবাক করে দিয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, ১৭ জনের মধ্যে এক ব্যক্তির গোসল করানোর সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ পুলিশ আমাকে ঘিরে রেখেছিল। আমার মাধ্যমে করোনাভাইরাস যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য তারা খুব সতর্ক ছিলেন। আমাকে হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখার চেষ্টা করেছিল। পরে তাদের প্রতি সম্মান রেখে নিজ বাড়িতে কয়েক দিন আইসোলেশনে ছিলাম। ওই সময় যদি কেউ ফোন দিত এবং মৃত ব্যক্তির গোসল দেওয়ার জন্য ডাকলে আর ঘরে বসে থাকতাম না। গোপনে তাদের গোসল দিয়ে এসেছি।

যেসব ঘটনা ভুলতে পারেননি শাহজাহান মুন্সি

অনেক মৃত মানুষের গোসল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক স্মৃতির ডালপালাও মনে দাগ কেটেছে শাহজাহান মুন্সির। কিছু কিছু ঘটনা তাকেও ভাবিয়ে তোলে। স্মরণীয় এমন এক ঘটনার কথা বলতে গিয়ে শাহজাহান মুন্সি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ১৩ বছর আগের ঘটনা। ওই ব্যক্তি খুবই অসুস্থ ছিলেন। তার সন্তান থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন কেউই পাশে যায়নি। কারণ গলায় টিউমার হয়ে পোকা ধরেছিল। দুর্গন্ধের কারণে কেউ গোসল করাতেও যায়নি। তাকে গোসল করাতে প্রায় ১৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গিয়েছিলাম। ওই মৃত ব্যক্তি বিত্তবান ছিলেন। গোসল ও দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর ওই পরিবার আমাকে টাকা দিয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই টাকা নিইনি। এছাড়া একজনকে হত্যা করে নদীতে চার দিন ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল। ওই মৃত ব্যক্তি যখন উদ্ধার হয়, তখন মরদেহ পচে-গলে একাকার। আমি সেই ব্যক্তিকেও গোসল দিয়েছি।

শাহজাহান মুন্সির শেষ ইচ্ছা

ঢাকা পোস্টকে শাহজাহান মুন্সি বলেন, ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল মক্কা-মদিনায় যাব, হজ পালন করব। আর মক্কা ও মদিনায় প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাজের পর মৃত ব্যক্তির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশগ্রহণ করা। কেননা জানাজা আদায়ে রয়েছে অনেক সওয়াব। প্রিয় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কাবা শরীফকে খুব ভালোবাসতেন। সুতরাং মনভরে কাবা ঘর দেখে নেওয়ার ইচ্ছে আছে। যদিও সেই অর্থ আর সামর্থ্য আমার নেই।

তিনি আরও বলেন, আমি গরিব মানুষ। আমার সংসার চলে আতরের গন্ধে। মনে সাধ আছে হজ করার কিন্তু সেই সাধ্য নেই। আমাদের এলাকার সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা সমাজের বিত্তবানরা যদি আমার দিকে একটু সুদৃষ্টি দেন তাহলে আল্লাহ আমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করবে। আমার জন্য যদি কেউ এই ব্যবস্থা করে দেন আমি তার জন্য আমৃত্যু দোয়া করবো। হজ করতে পারলেও মরলেও শান্তি পাব।

শাহজাহান মুন্সির পরিবার

জীবনযুদ্ধে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা শাহজাহান মুন্সির না পাওয়ার কোনো আক্ষেপ নেই। সুগন্ধি আতর বিক্রি করে যা আয় হয়, তাই দিয়ে চলছে স্বামী-স্ত্রীর সংসার। শাহজাহান মুন্সির চার সন্তান। এর মধ্যে তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তারা সবাই স্বামী-সংসার নিয়ে আলাদা থাকছেন। আর একমাত্র ছেলে থাকেন ঢাকায়, পেশায় থ্রি-হুইলার চালক।

এমজেইউ