গেজেট প্রকাশের আট বছরেও কাগজ-কলমেই আটকে আছে উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধ জেলা নীলফামারীর চিলাহাটি স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠার কাজ। উত্তরাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার আর আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট গেজেট প্রকাশ হয়। সেই থেকে আটকে থাকা স্থলবন্দরটি চালুর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণির মানুষ।

নীলফামারী জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার উত্তরে ডোমার উপজেলার ভোগডাবুড়ি ইউনিয়নে চিলাহাটির অবস্থান। ব্রিটিশ আমলে প্রসিদ্ধ ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত ছিল চিলাহাটি। সে সময় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে অনেক প্রতিষ্ঠানসহ গড়ে ওঠে শুল্ক স্টেশন ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট।

বর্তমানে চিলাহাটিতে রয়েছে একটি রেলওয়ে স্টেশন, দুটি সরকারি ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ, হাটবাজার, পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, বিজিবি ক্যাম্পসহ সরকারি, বেসরকারি নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এ ছাড়া নীলফামারী জেলায় রয়েছে উত্তরা ইপিজেড, দারোয়ানী টেক্সটাইল মিল, ছয়টি পাটকল, তিনটি সিরামিক কারখানা ও বেশ কিছু পোশাক কারখানা। পাশের জেলাগুলোয় গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্পকারখানা।

স্থানীয়রা জানান, চিলাহাটিতে স্থলবন্দর স্থাপিত হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাশাপাশি থাকা অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা রাজ্যসহ (সেভেন সিস্টার রাজ্য) সার্কভুক্ত নেপাল, ভুটান আর চীনের সঙ্গে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে যোগ হবে এক নতুন মাত্রা। নীলফামারীর উত্তরা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাসহ (ইপিজেড) দেশের অন্যান্য ইপিজেডের বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন ব্যবসায়ীরা। প্রসার ঘটবে ব্যবসা-বাণিজ্যের। ঘুচবে বেকারত্ব। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ফলে দেশ হবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। এতে দ্রুত পাল্টে যাবে উত্তরাঞ্চলের চিত্র।

তারা জানান, বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের মধ্যে অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও স্থলবন্দর স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। চিলাহাটিতে স্থলবন্দর স্থাপিত হলে এটিই হবে পার্শ্ববর্তী সার্কভুক্ত চারটি দেশের গেটওয়ে। তবে সরকার চাইলে এই রুটে সার্কভুক্ত সাতটি দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।

এদিকে দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ দশক পর গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর আর চলতি বছরের ২৭ মার্চ চিলাহাটি থেকে ভারতের নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত রেলপথে পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী রেল যোগাযোগ শুরু হয়। তবে রেলপথে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হলেও ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজন স্থলবন্দর স্থাপন করা।

আমদানি-রফতানিসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিলাহাটিতে স্থলবন্দর স্থাপিত হলে খুব দ্রুত ও স্বল্প ব্যয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রফতানি করা সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে রয়ালেক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী রাজকুমার পোদ্দার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে পরিবহন ব্যয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ী রুটে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হচ্ছে। তবে রেলপথে পণ্য পরিবহন ব্যয় সড়কপথে ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে চিলাহাটি স্থলবন্দর চালু হওয়া ছাড়া ব্যবসায়ী মহল উপকৃত হবে না।

ইকু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিদ্দিকুল আলম বলেন, সরকারের ঘোষণা থাকলেও চিলাহাটি স্থলবন্দরটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা দর্শনা, সোনা মসজিদ, বেনাপোল, হিলি ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে অধিক খরচে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রফতানি করছেন। স্থলবন্দরটি বাস্তবায়িত হলে উত্তরাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।

বিউটি সাইকেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী আলতাব হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন থেকে চিলাহাটি স্থলবন্দর স্থাপনের কাজ বন্ধ আছে। তবে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর স্থাপিত হলে সড়কপথে স্বল্প খরচে পণ্য আমদানি-রফতানি করে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী এর সুফল ভোগ করবেন।

১০ বছর আগে সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান চিলাহাটিতে একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৩ সালে স্থলবন্দরটির গেজেট হয়েছে। এটি স্থাপিত হলে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছাবে।

শাহ্ মো. শফিকুল আলম ডাবলু, সাবেক সভাপতি, নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি

নীলফামারী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন জানান, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী জেলায় একটি আইটি পার্ক, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ ভিন্ন কলকারখানা গড়ে উঠছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যুব উন্নয়ন অধিদফতর, সমাজসেবা অধিদফতরসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন দফতরে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নে চিলাহাটি স্থলবন্দর বাস্তবায়ন করতে এলাকাবাসীর পক্ষে সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

নীলফামারী জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে জানান, চিলাহাটিতে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর বাস্তবায়নে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ইতিমধ্যে কয়েকটি উচ্চপর্যায়ের দল সরেজমিন পরিদর্শন করে ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করেছে। খুব শিগগিরই চিলাহাটি স্থলবন্দর বাস্তবায়নে সরকারেরও সদিচ্ছা রয়েছে।

তিনি জানান, চিলাহাটি স্থলবন্দর বাস্তবায়িত হলে ভারতের সেভেন সিস্টারখ্যাত সাত রাজ্যসহ নেপাল আর ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের এক নবদিগন্তের সূচনা হবে।

এনএ