রামনাথহাটে গণহত্যায় নিহতদের নাম ও ঘটনার বিবরণ আজও লিপিবদ্ধ হয়নি
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠাকুরগাঁওয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা যেসব নির্মম বর্বরোচিত হত্যা সংঘটিত করেছিল তার মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া থানার ২০ নম্বর রুহিয়া ইউনিয়নের রামনাথহাট গণহত্যা অন্যতম।
এ হত্যাকাণ্ডে প্রাণ দিয়েছিলেন মোট ছয়জন এবং তারা প্রত্যেকে ছিলেন পরস্পরের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে গাঁথা।
বিজ্ঞাপন
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা দখল করার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রুহিয়ার রামনাথ হাটের নুরুল ইসলামের বাড়িতে সেনা ছাউনি স্থাপন করে। ৮ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা রুহিয়া ইউনিয়নের কানিকশালগাঁও গ্রাম থেকে ৬ জন গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায় রামনাথ হাটে নুরুল ইসলামের বাড়িতে।
নুরুল ইসলামের ছোট ভাই ফজলুল করিম ছিলেন ঠাকুরগাঁও-১ আসনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমপিএ এবং ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ধরে আনা ছয়জন মানুষই ছিলেন ফজলুল করিমের স্বজন।
বিজ্ঞাপন
আওয়ামী লীগের এই নেতার আত্মীয় হওয়ায় স্থানীয় আল-শামস বাহিনী ও রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ৬ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে অত্যাচার করে হাত, পা ও চোখ বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। তারা হলেন, রফিকুল ইসলাম (আবুল), আজিম উদ্দিন আহমেদ, আজিম উদ্দিন আহমেদের নাতি মো. বেলাল (বেলু), তার ছোট ভাই মো. জালাল, মো. রেজাউল ও দেলোয়ার।
এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট সকালে পাকিস্তানি দোসর আল শামস নেতা তাজিমসহ পাঁচজন স্থানীয় রাজাকার আবুল কাশেম ও মো. শরিফুল ইসলামকে রাস্তা থেকে ধরে রামনাথহাট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেদিনই রাত আটটার দিকে তাজিম খান কয়েকজন সহযোগী ও প্রায় ২৫ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে আজিমুদ্দিনের বাড়ি ঘেরাও করে। প্রথমে তারা আজিম উদ্দিনের স্ত্রীর ঘরে ঢোকে।
প্রত্যক্ষদর্শী আনসারুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ এর মাধ্যমে জানা যায়, পাকিস্তানি সৈন্যদের আগমনের খবর পেয়ে বাড়ির সব নারী শিশু ও কিশোররা আজিমুদ্দিনের স্ত্রীর ঘরে জড়ো হয়েছিল।
পাকিস্তানি সৈন্যরা ওই ঘর থেকে কিশোর রেজাউলকে বাড়ির অন্যান্য ঘর তল্লাশি করে আজিম উদ্দিন ও আরও চারজনকে ধরে সেনা ছাউনিতে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের সারারাত অমানসিক নির্যাতনের পর ১০ আগস্ট তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়।
পরে তাদের রামনাথহাট ক্যাম্পের পাশে এমপিএ ফজলুল করিমের বড় ভাই নুরুল ইসলামের বাড়ির ভেতরে রান্নাঘরে সিঁড়ির নিচে গর্ত করে মাটি চাপা দেয় তারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি শহীদদের গলিত ও বিকৃত লাশ তোলা হয়। পরনের কাপড় ও জুতা দেখে আত্মীয়-স্বজনরা লাশ শনাক্ত করেন। পরে লাশগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় নুরুল ইসলামের বাড়ির সামনেই দাফন করা হয়।
পরিবারের সদস্যরা শহীদদের কবরগুলো এখন পাকা করেছেন। কিন্তু কবরের দেয়ালে শহীদদের নাম, ঘটনার বিবরণ কিছুই লিপিবদ্ধ করা হয়নি।
লেখক : ফারজানা হক স্বর্ণা (এমফিল)
প্রভাষক-রত্নাই বগুলাবাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও
গবেষক-১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর, খুলনা