‘হামার বাপ-দাদারাও এই কাম করছে। হামরাও করছি। কিন্তুক আগের মতো আর সুদিন নাই। প্লাস্টিক হামার সুদিন কাড়ি নিছে বাহে। এ্যলা বাঁশের কুলা, ডালি, খাঁচা, চালন মানুষ তেমন কিনে না। প্লাস্টিক, স্টিল, মেলামাইনের তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা বেশি। ওই তকনে আগের মতো হামার কামের চাপও নাই, কামাইও নাই। কোনো মতো ধরি আছি।’ এভাবে কথাগুলো বলছিলেন বাঁশশিল্পনির্ভর মোবারক হোসেন।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের শালমারা গ্রামের সামছুদ্দিনের ছেলে মোরাবক হোসেন। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী মোবারকের বাপ-দাদাদের দেখানো পেশার সঙ্গেই নিবিড় সম্পর্ক। পরিবারের অন্যরাও এই শিল্পকে পেশা হিসেবে আগলে রেখেছেন।

মোবারক হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, গ্রামীণ জনপদের জনপ্রিয় বাঁশশিল্প ডালি, কুলা, চালন, চাটাই ও খাঁচা। একসময় গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে ব্যাপক চাহিদা ছিল পরিবেশবান্ধব এসব পণ্যের। বিশেষ করে নতুন বছরের অনুষ্ঠান, বিয়েবাড়ি, হালখাতা, কোরবানির ঈদে বেশ ভালো বিক্রি হতো বাঁশের তৈরি পণ্য। বর্তমানে হাতে তৈরি বাঁশশিল্প এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। আধুনিকতার সঙ্গে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যাপক হারে ব্যবহার বাড়ায় কদর নেই এসব হস্তশিল্পের।

মোবারক হোসেন সামছুদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, যুগ যুগ ধরি এই কাম করোছি। কিন্তু এ্যালা হামার বাঁশের তৈরি কুলা, ডালি, চালন, খাঁচার দাম নাই। হামার মতো গরিব মানুষের এ্যালা তো দুর্দিন যাওছে। আগের মতো বেচাবিক্রি নাই। পরিবার নিয়্যা কষ্টোতে আছি। ব্যাটার পায়োত সমস্যা। বাড়ি বসি যা পায় করে। অভাবের সংসারোত ব্যাটার বউ এ্যালা মাটি কাটার কাম করে।

পীরগাছা ছাড়াও সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুর সদরের সদ্যপুষ্করিণী, তারাগঞ্জের ঘনিরামপুর, গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ি ও মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ি, বদরগঞ্জের লালদিঘী এলাকায় কয়েক শ পরিবার বাঁশশিল্পের সঙ্গে জড়িত। তারা চাহিদানুযায়ী বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন শৈলীর ডালি, কুলা, চালন, চাটাই ও খাঁচাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করেন। তবে প্লাস্টিকের উত্থান কেড়ে নিয়েছে এই শিল্পের কদর। তাই কারিগররা অতিকষ্টে জীবন যাপন করছেন এখন। এভাবে চলতে থাকলে বিলুপ্তির তালিকায় উঠবে গ্রামীণ ঐতিহ্যের বাঁশের তৈরি সব গুরুত্বপূর্ণ পণ্য।

বংশপরম্পরায় এই শিল্পনির্ভর কারিগরদের এখন আর আগের মতো ব্যস্ততা নেই। বাজারেও নেই তাদের তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদাও। এতে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত এ শিল্পের কারিগররা।

ঘনিরামপুর নদীরপাড় পাটনীপাড়া গ্রামের বিনোদ বিহারী। বয়স ষাটের কাছাকাছি। বাপ-দাদাদের দেখানো পেশার সঙ্গেই তার নিবিড় সম্পর্ক। পরিবারের অন্যরাও এই শিল্পকে পেশা হিসেবে আগলে রেখেছেন। ঢাকা পোস্টকে বিনোদ বিহারী জানান, কৃষিকাজ ও গৃহস্থালিতে ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্রই বেশি তৈরি করেন তারা। বাঁশ দিয়ে কুলা, ডালি, খই চালান, মুড়ি চালান, খাটি, ডালি, চালুন, ধারার ডালি, মুরগি খাঁচা, টুকড়ি, ছাবা খাঁচা, ডোল খাঁচা, ডুলি, মাছ ধরা পলাই, চাংগাড়ি, বিয়ের চালুন, কবুতরের কাবু, খেলনা ঝুড়ি, রঙিন ডালাসহ অনেক সামগ্রী নিপুণভাবে তৈরি করেন। কিন্তু এ প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্রের কাছে বাঁশশিল্প এখন ধরাশায়ী। তাই আগের মতো এসবের চাহিদা নেই।

মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ির সেরুডাঙ্গা এলাকায়ও বেশ কয়েকটি পরিবার এই শিল্পের ওপর নির্ভর। তাদের প্রতিদিনের সকাল শুরু হয় বাঁশের চাটাই, ডালি, কুলাসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরির মধ্য দিয়ে। যুগ যুগ ধরে এখানকার নারী-পুরুষরা বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন। অথচ তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন নেই। এমনটাই মনে করেন কারিগর চিনু বালা। চার যুগেরও বেশি সময় ধরে তার মতো আরও অনেকেই হাতে তৈরি বাঁশের সামগ্রী তৈরি করেছেন।

সদ্যপুষ্করিনী ইউনিয়নের কেশবপুর উত্তরপাড়ার কফিল উদ্দিন বাঁশের তৈরি পণ্য তৈরির পাশাপাশি এখন কৃষিকাজ করেন। ঢাকা পোস্টকে এই কৃষক বলেন, এখন একটা ভালো বাঁশ কিনতে গেলে ৪০০ টাকার নিচে নেই। সেই বাঁশ দিয়ে কমপক্ষে ৮০০ টাকার সামগ্রী তৈরি করা যায়। এর জন্য দুই-তিনজনকে শ্রমও দিতে হয়। হাটবাজারে ঘুরে তারপরও সেগুলো বিক্রি করলে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত থাকে। এভাবে সংসার চালানো কঠিন হয়ে উঠেছে। এ জন্য কৃষি কাজও করছি।

বদরগঞ্জের লালদিঘীর হাটে কথা হয় নাজিম মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে বাঁশের তৈরি কুলা, চালুন, ডালি, খাঁচা, ডুলি, বিয়ের চালুন, কবুতরের কাবু/ঘরসহ কত কিছু তৈরি করতাম। এখন তো আর চাহিদা নেই। বর্ষাকালে মাছ ধরা পলাই, চাংগাড়ি, পয়লা বৈশাখের সময় খেলনা ঝুড়ি, রঙিন ডালা, কুলা খুব বিক্রি হতো। কিন্তু আগের মতো চাহিদা নেই, বিক্রিও নেই। বাপ-দাদার পেশা হিসেবে এই শিল্পকে ধরে আছি। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে একসময় শিল্পের করুণ পরিণতি হবে।

এদিকে রংপুর মহানগরীর লালবাগ হাটের ব্যবসায়ী গোলাপ হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, বাঁশের তৈরি পণ্যের একসময় খুব চাহিদা ছিল। তখন বিভিন্ন মৌসুমের আগে বাঁশের পণ্যসামগ্রী মজুত করে রাখা হতো। কিন্তু এখন তেমন চাহিদা নেই। সবখানে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বেড়ে গেছে। এই পরিস্থিতি শুধু শহরে নয়, গ্রামেও রয়েছে বলে তারা জানান।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) রংপুরের উপমহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মো. শামীম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কালের বিবর্তনে এখন আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যের বাঁশশিল্প, হস্তশিল্প হুমকির মুখে। এসব শিল্পের প্রসারে সরকার কাজ করছে। আমরা বিভিন্নভাবে এই শিল্পনির্ভরদের আর্থিক সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। তবে এই শিল্পকে টিকে রাখার জন্য এখন পর্যন্ত আলাদা কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। আধুনিকতার সঙ্গে প্লাস্টিক শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ও প্রচলনের কারণে বাঁশশিল্প বর্তমানে দৈন্যদশা নেমে এসেছে বলেও তিনি জানান।

এনএ