১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী সোহাগপুর গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তাদের দোসর ও দেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় ছয় ঘণ্টা তাণ্ডব চালায়। এ সময় তারা গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ১৮৭ জন পুরুষকে হত্যা করে। সে ঘটনায় পাকিস্তানি হায়েনাদের নির্যাতনে সম্ভ্রম হারান অনেকে এবং বিধবা হন ৬৪ জন নারী। সেই ভয়াল দিনের কথা মনে করে এখনো কান্না করেন সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর (বর্তমান নাম বীরকন্যা পল্লী) বীরাঙ্গনা ও বিধবা নারীরা।

সোহাগপুরের বিধবাপল্লীতে ঢাকা পোস্টের কথা হয় বীরাঙ্গনা হাফিজা বেওয়ার। তিনি বলেন, তখন আমি নববধূ। বিয়ের মাত্র দুই মাস হয়েছে। হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনী সকাল ৭টার দিকে এলাকায় ঢুকলো। স্থানীয় রাজাকাররা পাক বাহিনীদের খবর দিছে, আমরা এলাকাবাসী মুক্তিবাহিনীদের খাবার দেই, বাড়িতে থাকার জায়গা দেই। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই তারা গুলি শুরু করে। এ এলাকার কোনো পুরুষ বেঁচে ছিল না। চারদিক শুধু লাশ আর লাশ। কবর দিবে, জানাজা করবে সেই সাহসও কারও ছিল না। 

বর্তমান বিধবাপল্লীর সভাপতি জালাল মিয়া তিনিও তখন ছোট। এই জালাল মিয়া তখন এই লাশগুলো একত্র করে কোনোটিতে ২টি, কোনোটাতে ৪টি লাশ রেখে মাটি চাপা দেয়। 

এ সময় হাফিজা আরও বলেন, বাবা সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো মাথা ঠিক থাকে না। চারদিক লাশ আর রক্তের স্রোত। কলা গাছের ভেতরের নরম অংশ, কাঁচা কাঠাল, কচুশাক এগুলো কোনো রকম আধাসিদ্ধ করে খাইছি। ঘরে লবণ পর্যন্ত ছিল না। সে সময় ৫০ গ্রাম লবণের দাম ছিল ২৫ টাকা।

বীরাঙ্গনা হাফিজা বেওয়া

বীরাঙ্গনা মহিরন বেওয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, দিনটি শ্রাবণ মাসের ১০ তারিখ মঙ্গলবার ছিল। পাকবাহিনী এলাকায় ঢুকে আমার শ্বশুর, স্বামী, ভাই, চাচা সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে রাইফেলের সামনে চাকু (বেয়নেট) দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত বের করে।

এরপর দেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়। আমার শাশুড়ি এদিক সেদিক ঘুরে শাকসবজি আনতো। সেটি আমিসহ আমার ৪ ননদ কোনোমতো রান্না করে খেতাম। সে দিনগুলোর কথা আমরা মনে করতে চাই না। কারণ এ রকম ভয়াল দিন যেন কোনো মানুষের জীবনে না আসে। 

মহিরন বেওয়া আরও বলেন, এভাবে একদিন দেশ স্বাধীন হলো। চারদিকে তখন অভাব-অনটন। আমরা পরিবারের ৫ জন বিধবা নারী মিলে বাঁশ দিয়ে টুকটাক জিনিসপত্র বানিয়ে সেগুলো বাজারে বিক্রি করতাম। তারপরও অভাব যখন পিছু ছাড়ছিল না তখন শাশুড়ি আমার এক সৎ ভাইয়ের কাছে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। 

সৎ ভাইয়ের সংসারে গিয়েও সুখ না পেয়ে দীর্ঘদিন মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করেছি। সম্বল বলতে একটি পানি খাওয়ার গ্লাসও ছিল না। যাই হোক এখন শেখ হাসিনা ও মতিয়া চৌধুরীর কারণে ঘর পাইছি। শেষ বয়সে আরেকটি জিনিস চাই। আমার একমাত্র ছেলে অসুস্থ। নাতি মেট্রিক পাস করে ময়মনসিংহে পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে নাতিটার জন্য একটি সরকারি চাকরি চায়।

জবেদা বেওয়া

বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জবেদা বেওয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই সকালে আমার স্বামী জমিতে হালচাষ করছিল। সেখানে পাকবাহিনীর গুলি খেয়ে আহত অবস্থায় প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে লুকায়। সে ঘরে যে কয়জন লুকিয়েছিল সবাইকে পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করছে। 

জবেদা আরও বলেন, চারদিকে লাশের মাঝে আমি যখন আমার স্বামীকে খুঁজতেছিলাম তখন প্রতিবেশী একজন ভাতিজা আমাকে খবর দেয় যে আমার স্বামী মুমূর্ষু অবস্থায় আহত হয়ে ধান খেতে পড়ে আছে। এরপর অনেক কষ্টে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসি। বুকের কয়েক জায়গায় গুলি লাগে।

একটি গুলি খুব কষ্টে বের করলে ফিনকি দিয়ে তাজা রক্ত বের হতে শুরু করে। তারপর শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করি। তাতেও কাজ না হলে ঘর থেকে মশারি খুলে শরীরে ব্যবহার করি। এরপর মইয়ের ওপর শুইয়ে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার সময় সেখানেই তিনি মারা যান। 

তিনি আরও বলেন, একটু জমি ছিল। স্বামী মারা যাওয়ার পর বিভিন্ন লোকে টাকা দাবি করে, তারা আমার স্বামীর কাছ থেকে টাকা পায়। সব মিথ্যা জেনেও শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে তাদের দেনা পরিশোধ করি। আগে ১০০ টাকা ভাতা পাইতাম। এখন শেখ হাসিনার কারণে ১২ হাজার টাকা পায়।

নিজস্ব জমির কারণে সরকারি ঘরের বরাদ্দটা বাতিলের পথে ছিল। এরপর বিভিন্ন জায়গায় টাকা পয়সা ধারদেনা করে ২ লাখ টাকা দিয়ে এই জমিটুকু কিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় যাদের কারণে ও সহযোগিতায় এলাকায় পাকসেনারা এলো সেই কাদের ডাক্তারসহ অনেকের বিচার আমরা দেখে যেতে পারলাম না।

সোহাগপুর বিধবা পল্লী উন্নয়ন সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন

১৯৭১ সালে সেই গণহত্যার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ও সোহাগপুর বিধবা পল্লী উন্নয়ন সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সে সময়ের নির্মমতা ও ভয়াবহতার কথা বলতে গেলে আমার শরীরের লোমগুলো সব দাঁড়িয়ে যায়। সব ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ সব কিছু কেড়ে নিল হানাদার বাহিনী। 

সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই। পাকবাহিনী এলাকায় প্রবেশ করে অনবরত গুলি করতে। তারা আমাদের বাড়িতে এসে বাবা, ভাইসহ সকলকে হত্যা করে। আমি দৌড়ে ঘরের মাচার মধ্যে লুকিয়ে নিজেকে রক্ষা করি। সোহাগপুরের কোনো পুরুষ বেঁচে ছিল না, আমি ছাড়া। তাই আমাকেই লাশগুলো একত্র করে মাটি চাপা দিতে হয়েছে। জানাজা করার মতো লোক ছিল না। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি সোহাগপুরের বিধবাদের পাশে আছি। তাদের সকল সুখ দুঃখের ভাগিদার আমি। 

শেখের বেটি শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরী, শেরপুরের সাবেক এসপি কাজী আশরাফুল আজিম, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ও এলজিইডির কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তাদের কারণে এ গ্রামের ২৯ জন বিধবা একতলা বিশিষ্ট পাকা বাড়ি পেয়েছেন। তবে আরও ৫ জন বিধবা এখনো সরকারি বরাদ্দের বাড়ি পায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য বাড়ি করে দিলে তারাও খুশি হতো। 

জালাল উদ্দিন আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তাদের সহযোগিতা করেছি, শহীদদের লাশ কবরস্থ করেছি, তাদের পরিবরের সকলের খোঁজ খবর রেখেছি কিন্তু আমাকে আজ পর্যন্ত সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো না।

এসপি