আকাশে ওড়ার স্বপ্ন সবাই দেখে। বিমান ভ্রমণে অনেকেই সেই স্বপ্ন সফল করতে পারেন। তেমনই বিমানে উঠে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখেছিল মানিক মিয়া নামের ১০ বছর বয়সী এক শিশু। সেই স্বপ্নপূরণের জন্য ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে জমিয়েছিল ১৫০ টাকা। 

জমানো সেই টাকা দিয়ে রংপুর থেকে নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে পৌঁছে নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে ঢুকে পড়ে ভিআইপি লাউঞ্জে। তবে বিমানে ওঠা হয়নি তার। ভিআইপি লাউঞ্জে আটকে দেওয়া হয় তাকে। গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৭টার দিকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে এ ঘটনা ঘটে।

মানিক মিয়া রংপুর মহানগরীর দেওডোবা এলাকার অটোরিকশা চালক মিঠু মিয়ার ছেলে। সে নগরীর হাজী তমিজ উদ্দীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী।
বিদ্যালয়ের পাশের একটি ফার্নিচার দোকানে বিদ্যালয় ছুটির পর কাজ করে সে। রোববার স্কুল বন্ধ থাকায় দিনভর বাড়িতে থেকে বিকেল ৪টার দিকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয় সে।

মানিক মিয়ার প্রতিবেশী ও পরিবারের লোকজন জানান, তিন ভাই-বোনের মধ্যে সে ছোট। মানিক ছোটবেলা থেকেই চঞ্চলপ্রকৃতির। পাঁচ মাস বয়সে তাকে রেখে মা অন্যত্র চলে যায়। অটোরিকশার চালক বাবার আয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ায় সে শহরের একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে। সেই দোকানমালিক তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন।

তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তিন শতক জমির ওপর একটি টিনের ঘর। সেই ঘরের সামনের চুলায় রান্না বসিয়েছেন তার দাদি। সেখানে বসে আছে মানিক। তাকে ঘিরে প্রতিবেশীদের জটলা। সে তাদের শোনাচ্ছিল বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছানোর গল্প।

শিশু মানিক মিয়া জানায়, রোববার আসরের আজানের পর বাড়ি থেকে বের হয় সে। ১০ টাকা অটো ভাড়া দিয়ে আসে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে। এরপর সেখানে বাস না পেয়ে আরও ১০ টাকা দিয়ে মেডিকেল মোড়ে পৌঁছায় সে। সেখানে ৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে বাসে করে সৈয়দপুর বাস টার্মিনালে যায়। সেখান থেকে ৫০ টাকায় একটি রিকশা ভাড়া করে বিমানবন্দরে যায়। সেখানে দুজন যাত্রীর পেছন নিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছায় সে।

মানিক মিয়া বলে, আমার অনেক দিনের শখ বিমানে ওঠার। মানুষ নিয়ে বিমান কীভাবে আকাশে উড়ে তা দেখার। সে জন্য বিমানবন্দরে গেছি। বাইরে থেকে ঘুরে দেখছি ভেতরে ঢোকা যাবে না। এরপর ভিআইপি গেট দিয়া ভেতরে ঢুকছি। আমাকে কেউ কোনো বাধা দেয়নি। ভেতরে ঢুকে বসেছিলাম। এরপর একজন অফিসার আমাকে জিজ্ঞাসা করে। আমি ঠিকানা বললে, তারা কাউন্সিলরকে ফোন দেন, কাউন্সিলর বাবাকে বললে আমাকে নিয়ে আসে। আমি বিমানে উঠতে পারিনি। আমার স্বপ্ন আমি বিমানের পাইলট হবো।

মানিকের বাবা মিঠু মিয়া বলেন, আকাশে বিমান উড়লে তা দেখতে ছোটবেলা থেকেই ঘর থেকে বাইরে ছুটে যায় সে। তার খুব ইচ্ছে বিমানে চড়ার। সে প্রায় রাতে আমাকে বলে একদিন বিমানে উঠব, বিমান চালাব। অভাবের জন্য বাচ্চাটাকে মানুষের দোকানে রাখছি। সেই দোকানের মালিক তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিছে। কাল সেই মহাজনের সঙ্গে ঢাকা যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থাকি বের হয়েছে। রাতে শুনি ঢাকা না বিমানে ওঠার জন্য সৈয়দপুর গেছে। পরে অনেক রাতে বিমানবন্দর থেকে মানিককে বাড়ি নিয়া আসছি।

স্থানীয় এ অ্যান্ড জেড ডোরস সিস্টেমের মালিক জিয়াউর রহমান বলেন, মানিক অত্যন্ত ভালো ছেলে। তার মা তাকে রেখে অন্যত্র চলে গেছে। আমিও এতিম। তাই তাকে আমার কাছে রেখে লেখাপড়া করাচ্ছি। সে বিদ্যালয় ছুটির পর আমার ফার্নিচারের দোকান দেখাশোনা করে। প্রায় আমাকে বিমানে ওঠার কথা বলতো সে।

হাজী তমিজ উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহানারা বেগম বলেন, মানিক আমার বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্কুলে আসার পর বিমানবন্দরে যাওয়ার ঘটনাটি শুনেছি। তার মা নেই, কেয়ার করার মতো কেউ নেই। তাকে অনুকূল পরিবেশ ও আর্থিক সহায়তা করলেও সে ভালো কিছু করবে।

বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশন সুপারভাইজার ফাহমিদ হাসিব জানান, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ভেদ করেই মানিক লাউঞ্জে ঢুকে পড়ে। কিন্তু আমরা সতর্ক ছিলাম। ফলে সে ধরা পড়ে।

বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সুপ্লব কুমার ঘোষ বলেন, আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশনের নিয়ম অনুযায়ী অবৈধভাবে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে প্রবেশ করা একটি অপরাধ। তবে অনুপ্রবেশকারী একটি শিশু। বিষয়টি মানবিকভাবে দেখা হচ্ছে। পরে শিশুটিকে তার বাবার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

এর আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর দশ বছরের এক শিশু ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি ফ্লাইটে উঠে পড়েছিল। পরে তাকে জিম্মায় নিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে কর্তৃপক্ষ। সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত ছিল সেই ঘটনা।

এমএএস