হবিগঞ্জে ‘দি জাপান বাংলাদেশ হসপিটাল’ নামের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রহিমা খাতুন নামের এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় পরিচালক-চিকিৎসকসহ চারজনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন হাইকোর্ট। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) তারা আগাম জামিন নিতে গেলে বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও মো. বশির উল্লার বেঞ্চ তাদের জামিন আবেদন খারিজ করে দেন।

পরে আদালত তাদের সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে শাহবাগ থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। চারজন হলেন- গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. এস কে ঘোষ, হাসপাতালের পরিচালক এ কে আরিফুল ইসলাম, তার ভাই তাবির হোসাইন ও হাসপাতালের ম্যানেজার জনি আহমেদ।

হাইকোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম মাসুদ রুমি এই আদেশের ব্যাপারে গণমাধ্যমকে বলেন- ‘কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক চিকিৎসাসেবার নামে ব্যবসা করছে। এ ধরনের অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। সমাজে এমন বার্তা যাওয়া প্রয়োজন, যাতে অন্যরা সতর্ক হয়। আদালত চিকিৎসকের উদ্দেশে বলেন- তিন দিনের মাথায় এমন গুরুতর রোগীকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন, এতে তার অবহেলা রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।’

মামলার বাদী রহমত আলী জানান, তার চাচাতো বোন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বড় বহুলা গ্রামে মৃত নূর আলীর স্ত্রী রহিমা আক্তার (৫৫) পেটে টিউমারের অপারেশন করতে গিয়ে ভুল চিকিৎসায় মারা যান। এ অভিযোগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর উল্লিখিত চারজনকে আসামি করে হবিগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন। আদালতের বিচারক মো. জাকির হোসাইন মামলার গুরুত্ব, প্রকৃতি ও নিবিড়ভাবে তদন্তের স্বার্থে মামলাটি হবিগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জকে এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। গত বুধবার (৮ নভেম্বর) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মঈন খান এলিসের নির্দেশে ময়নাতদন্তের জন্য রহিমা খাতুনের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়।

ডা. এস কে ঘোষ এবং পরিচালক এ কে আরিফুল ইসলাম

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ডা. এস কে ঘোষ ও অন্য আসামিরা হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে আসা রোগীদের ভুল বুঝিয়ে দি জাপান হাসপাতালে নিয়ে যান। গত ৯ সেপ্টেম্বর রহিমা খাতুন পেটে টিউমারের চিকিৎসার জন্য হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালে যান। এ সময় দি জাপান বাংলাদেশ হসপিটালের পরিচালক এ কে আরিফুল ইসলাম, তার ভাই তাবির হোসাইন ও হাসপাতালের ম্যানেজার জনি আহমেদ স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসার কথা বলে রহিমা খাতুনকে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান। এ সময় ডা. এস কে ঘোষকে একজন বিখ্যাত সার্জন হিসেবে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

ওইদিন রাতেই এই চিকিৎসক (ডা. এস কে ঘোষ) পেটে টিউমার অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচার করেন। ১২ সেপ্টেম্বর ছাড়পত্র দিয়ে রোগীকে হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এরপর ১ নভেম্বর রহিমা খাতুনের অবস্থার অবনতি হলে ওই হাসপাতালে (দি জাপান বাংলাদেশ হসপিটাল) ডা. এস কে ঘোষের অধীনে নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। এ সময় অবস্থার আরও অবনতি হলে রোগীকে হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু রহিমা খাতুনের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হলে তাকে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসকগণ জানান- রহিমা খাতুনের পেটে টিউমার অপারেশনের সময় চিকিৎসক খাদ্যনালি, জরায়ু ও বামপাশের কিডনি কেটে ফেলেছেন। সেইসঙ্গে পেটে থাকা পাথরও ঠিকমতো অপসারণ করা হয়নি। ফলে রোগীর বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। অবশেষে ১৫ সেপ্টেম্বর ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় ওই নারীর।

মামলার বাদী রহমত আলী বলেন- রহিমা আক্তারের স্বামী নেই। তার ছেলে বর্তমানে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একমাত্র মেয়ে আছে শ্বশুরবাড়িতে। যে কারণে আমাকে মামলার বাদী হতে হয়েছে।

উল্লেখ্য, হবিগঞ্জ শহরের দি জাপান বাংলাদেশ হসপিটালের বিরুদ্ধে এর আগেও বেশ কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এ কে আরিফুল ইসলামকে জরিমানার পাশাপাশি কারাদণ্ডও দেওয়া হয়। এছাড়া প্রশাসনের অভিযানের মুখে অপারেশন থিয়েটারে রোগী রেখে দুই চিকিৎসক পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল।

এই বিষয়ে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নুরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই হাসপাতালে (দি জাপান বাংলাদেশ হসপিটাল) অভিযান চালিয়ে সিলগালা করা হয়। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছে।

আজহারুল মুরাদ/এমজেইউ