তীব্র শীতে নাকাল কুষ্টিয়া

তীব্র শীতে নাকাল কুষ্টিয়া। সন্ধ্যার পর থেকে সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত কুয়াশা পড়ে। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে দুপুর ছাড়া সবসময় শীতের পোশাক পরতে হয় স্থানীয়দের। শীতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছেন দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষ। জেলার শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বরাদ্দ দিলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।

সরকারের পক্ষ থেকে জেলায় চাহিদার তুলনায় অনেক কম কম্বল দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন উপজেলার সরকারি কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার ছয় উপজেলায় সরকারের পক্ষ থেকে ৩২ হাজার ২০০ কম্বল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এত অল্প কম্বল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন জেলা ত্রাণ অফিসের কর্মকর্তা, পৌরসভার মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং মেম্বার। শীতার্ত মানুষের সংখ্যার তুলনায় শীতবস্ত্রের বরাদ্দ কম। 

তবে পর্যায়ক্রমে সরকারের পক্ষ থেকে আরও কম্বল দেয়া হবে। তখন শীতার্তদের কষ্ট হবে না। তবে জেলায় শীতার্ত মানুষের সংখ্যা কত তা জানাতে পারেননি ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা।

জেলা পরিসংখ্যান অফিসের উপপরিচালক আব্দুল আলীম বলেন, ২০১১ সালের আদমশুমারির পরিসংখ্যান অনুযায়ী কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালী, দৌলতপুর, মিরপুর, ভেড়ামারা ও খোকসা উপজেলায় জনসংখ্যা ১৯ লাখ ৪৬ হাজার ৮৩৮ জন। জেলায় দারিদ্র্যের হার ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং অতিদরিদ্র ১২ শতাংশ।

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৬০৮.৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কুষ্টিয়া জেলা ৯৭৯ গ্রাম নিয়ে গঠিত। জনসংখ্যা ২৩ লাখ ৬৬ হাজার ৮১১। এর মধ্যে ৫০ দশমিক ৮৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৪১ দশমিক ১৪ শতাংশ নারী।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) যৌথভাবে বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ করে। সেই তথ্য অনুযায়ী কুষ্টিয়ায় দারিদ্র্যের হার মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে কম কুষ্টিয়ায়।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাউজিং এলাকার মন্ডল পেট্রল পাম্পের বিপরীতে খোলা আকাশের নিচে বেদে সম্প্রদায়ের বসবাস। শতাধিক বেদে পরিবারের এখানে থাকে।

এখানের বাসিন্দারা জানান, তীব্র শীতে খোলা আকাশের নিচে পলিথিনে ঘেরা ঘরে রাতে ঘুম আসে না। শীতবস্ত্রের অভাব। কম্বল নেই, শীতের পোশাক নেই। আমাদের কেউ শীতবস্ত্র দেয়নি। সরকারের কাছে শীতবস্ত্র চাই।

দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুন্ডি ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামের শহীদ মন্ডল বলেন, আমার কোনো ছেলে সন্তান নেই। এক প্রতিবন্ধী মেয়ে আছে। বৃদ্ধ হয়ে গেছি; এখন কাজ করতে পারি না। শীতের কম্বল নেই; পোশাক নেই। আমাদের খুব কষ্ট হয়। সরকারের কাছ থেকে কম্বল চাই; শীতের কাপড় চাই। 

দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম ফজলুল হক বলেন, আমার ইউনিয়নের জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। বেশির ভাগ মানুষ নদীভাঙনের শিকার। নদী পাড়ের শীতার্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। এদের শীতের কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই। তারা খুব কষ্টে আছেন। অথচ সরকারিভাবে মাত্র ২০০ কম্বল পেয়েছি।

চেয়ারম্যান একেএম ফজলুল হক বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের ৬৮ গ্রামে নয় ওয়ার্ড রয়েছে। ইউপি সদস‌্যদের নিজ নিজ এলাকায় বিতরণের জন্য কম্বল দিয়েছি। সরকার থেকে যেসব কম্বল দেওয়া হয়েছে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। কাকে ছেড়ে কাকে কম্বল দেব বুঝতে পারছি না। দুস্থ লোকজন শীতবস্ত্র ও কম্বলের জন্য ইউপি কার্যালয়ে ভিড় করছেন। আমার ইউনিয়নে আরও তিন হাজার কম্বল প্রয়োজন।

ফিলিপনগর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আমিনুল ইসলাম আন্টু বলেন, আমার এলাকায় অর্ধেকের বেশি গরিব মানুষের বসবাস। ওয়ার্ডের জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। চেয়ারম্যান মাত্র আটটি কম্বল দিয়েছেন। আটটি কম্বল বিতরণ করেছি। এখন আমার বাড়িতে প্রতিদিন সুস্থ ও দরিদ্র মানুষ কম্বলের জন্য ভিড় করছেন। তাদের কথার জবাব দিতে পারছি না। তাদের কোনোভাবেই বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না সরকারি বরাদ্দ কম। কারণ তারা শীতে খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমি বাড়িতে থাকতে পারছি না। এখন আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার ওয়ার্ডে কমপক্ষে এক হাজার কম্বল প্রয়োজন।

ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল মারুফ বলেন, উপজেলায় তিন হাজার ২০০ কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। বিতরণের জন্য এগুলো ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তারা সেগুলো বিতরণ করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আরও কম্বল চাওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও বরাদ্দ আসবে। আমাদের কাছে আসামাত্রই সেগুলো বিতরণ করা হবে। তখন শীতার্ত মানুষের কষ্ট দূর হবে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুস সবুর বলেন, কুষ্টিয়ায় ৩২ হাজার ২০০ কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এসব কম্বল পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪৬০টি করে কম্বল। যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। আমাদের আরও বরাদ্দ আসবে। বরাদ্দ পেলেই শীতবস্ত্র শীতার্তদের মাঝে পৌঁছে দেওয়া হবে।

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আসলাম হোসেন বলেন, জেলায় প্রথম ধাপে সরকারের পক্ষ থেকে যা বরাদ্দ এসেছে আমরা সেগুলো শীতার্তদের মধ্যে বিতরণ করেছি। আগামীতে আরও শীতবস্ত্র ও নগদ অর্থ বরাদ্দ আসবে। পর্যায়ক্রমে আমরা সেগুলো দুস্থদের মাঝে বিতরণ করব। জেলার সব মানুষ শীষবস্ত্র পাবে।

এএম