রংপুরে বিভাগে ২৬টি আইসিইউ বেডে চলছে করোনা চিকিৎসা
রংপুর বিভাগে প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সংক্রমণের সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। যতই দিন যাচ্ছে ততই করোনার ভয়ঙ্কর আঘাতে চিকিৎসা সেবা নিয়ে শঙ্কিত হচ্ছেন আক্রান্ত রোগীরা।
বিশেষ করে মুমূর্ষু রোগীদের জন্য সহসা মিলছে না আইসিইউ সুবিধা। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল আইসিইউ বেড থাকায় কাঙ্খিত সেবা দিতে বেসামাল পরিস্থিতির সম্মুখীন চিকিৎসকেরা। করোনা আক্রান্ত রোগী ও তাদের স্বজনরা বলছেন, বিভাগের প্রতিটি জেলাতেই আইসিইউ সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলে অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন।
বিজ্ঞাপন
রংপুর বিভাগের আট জেলায় আইসিইউ বেড রয়েছে মাত্র ২৬টি। এর মধ্যে দিনাজপুরে ১৬টি ও রংপুরে ১০টি। এছাড়া পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা- এ ছয় জেলার সরকারি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ সুবিধা নেই। অথচ গত বছরের এপ্রিল থেকেই আইসিইউ সুবিধা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে বিভাগের আট জেলার প্রায় সোয়া কোটি মানুষ।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, রংপুর বিভাগের আটজেলায় বিশেষায়িত ১২টি হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৫০৬টি বেড রয়েছে। ৫০৬ শয্যার মধ্যে রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে ১০০টি, রংপুর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ২০, হারাগাছ হাসপাতালে ৩১টি, দিনাজপুরে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০টি, পঞ্চগড় আধুনিক সড়ক হাসপাতালে ২০, নীলফামারীর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ১০০টি, কুড়িগ্রামে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ৫০টি, ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে ৫০টি, গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে ২০টি, লালমনিরহাট নার্সিং কলেজে ১২টি, লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালে ১৫ এবং লালমনিরহাট সরকারি কলেজের মহিলা হোস্টেলে ৬৪টি বেড রয়েছে। এছাড়াও বিভাগের ৫৮ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে করোনা রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এদিকে গত বছরের এপ্রিলে রংপুরে বিশেষায়িত করোনা হাসপাতালে ৫০টি আইসিইউ বেড স্থাপনের বরাদ্দ দেন স্বাস্থ্য অধিদফতর। করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য আইসিইউ বেড স্থাপনের বরাদ্দ ঘোষণা করা হলেও এখন পর্যন্ত ১০টি ছাড়াও বাকি বেড স্থাপন করা হয়নি। বর্তমানে নবনির্মিত ১০০ শয্যা বিশিষ্ট রংপুর শিশু হাসপাতালটিকে ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ ও ৯০টি জেনারেল বেড স্থাপন করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
রংপুর বিভাগে মানুষের অসচেতনতা, অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে করোনার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। প্রতিদিন মৃত্যুর হার বাড়ছে, বাড়ছে সংক্রমণও। করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ শুরুর পর (মার্চ ২০২১ হতে) সংক্রমণের হার ২% থেকে ২৪% শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আশঙ্কা ও উদ্বেগের কারণ। বিভাগে মোট আক্রান্তের মধ্যে দিনাজপুরে সবচেয়ে বেশি ৫ হাজার ২১৩ জন আক্রান্ত ও লালমনিরহাটে সবচেয়ে কম ১ হাজার ২৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
গত বছরের ৮ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত বিভাগের আট জেলায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৭ হাজার ৩৬৭ জন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৩২৯ জন। সুস্থ হয়েছেন ১৬ হাজার ৫৩ জন।
রোববার (১৮ এপ্রিল) রাত পর্যন্ত বিভাগের সবচেয়ে বড় রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে ৪১ জন করোনা রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এরমধ্যে সংকটাপন্ন অবস্থায় আইসিইউ বেডে রয়েছেন সাতজন রোগী।
স্বাস্থ্যবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ দিনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে রংপুর বিভাগে ১১ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার একদিনেই মারা গেছেন ৪ জন। এদের মধ্যে তিনজন রংপুর কোভিড হাসপাতালে, একজন গাইবান্ধায়। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় (রোববার ১৮ এপ্রিল) একদিনে ৩৮০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে নতুন করে ৭৩ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে রংপুরে ২৮, দিনাজপুরে ২৫, গাইবান্ধায় ৮, নীলফামারীতে ৫, লালমনিরহাটে ৪, কুড়িগ্রামে ২ এবং ঠাকুরগাঁও জেলায় ১ জন করোনায় শনাক্ত হয়েছেন। একই সময়ে রংপুর জেলায় একজন মারা গেছেন।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয় সূত্র আরও জানায়, রোববার পর্যন্ত দিনাজপুুর জেলায় ৫ হাজার ২১৩ জন আক্রান্ত ও ১১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। রংপুর জেলায় ৪ হাজার ৪৪৪ জন আক্রান্ত ও ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, ঠাকুরগাঁও জেলায় ১ হাজার ৬১৪ জন আক্রান্ত ও ৩৪ জনের মৃত্যু।
গাইবান্ধা জেলায় ১ হাজার ৬৪৭ জন আক্রান্ত ও ২১ জনের মৃত্যু, নীলফামারী জেলায় ১ হাজার ৪৮৯ জন অক্রান্ত ও ৩৩ জনের মৃত্যু। কুড়িগ্রাম জেলায় ১ হাজার ১০০ জন আক্রান্ত ও ১৭ জনের মৃত্যু, লালমনিরহাট জেলায় ১ হাজার ২৫ জন আক্রান্ত ও ১১ জনের মৃত্যু, পঞ্চগড় জেলায় ৮২০ জন আক্রান্ত এবং ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিভাগে করোনার নমুনা পরীক্ষা করার ব্যাপারে আলাদা করে কোথাও বুথ খুলে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে না। ফলে নমুনা দেওয়ার জন্য মানুষকে উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। নমুনা দেওয়ার পর ফলাফল জানতে সপ্তাহখানেক সময় লাগাতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে নমুনা দেওয়া ব্যক্তির মাধ্যমে। বর্তমানে পুরো বিভাগের ৫৮ উপজেলার মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে রংপুর মেডিকেল কলেজ এবং দিনাজপুরে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে। আট জেলার মানুষের জন্য মাত্র দুটি পিসিআর ল্যাব দিয়ে প্রতিদিনের নমুনা পরীক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে করে নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পেতে বিলম্ব হচ্ছে।
রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালের এক চিকিৎসক পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে জানান, করোনা রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে। আইসিইউ সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। বর্তমান সংকট মোকাবিলার জন্য ১০টি আইসিইউ বেড যথেষ্ট না। প্রয়োজনে বেসরকারি আইসিইউ বেড এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও করোনভাইরাস রোগীদের চিকিত্সার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
করোনা মোকাবেলা ও জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য মাঠে থাকা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উই ফর দেম এর প্রতিষ্ঠাতা জীবন ঘোষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। মানুষের মধ্যে করোনা ভীতি নেই। যে যার মতো ঘুরছে ফিরছে, কোথাও স্বাস্থ্যবিধি ঠিক মতো মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে করোনায় আক্রান্তদের আইসোলেশনে রাখার কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না স্বাস্থ্য বিভাগসহ প্রশাসন। ফলে সংক্রমণের হার বাড়ছে।
রংপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. হিরম্ব কুমারের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, রংপুর মহানগর এলাকায় সিটি করপোরেশন নমুনা সংগ্রহ করছে। তারা বিদ্যালয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা ব্যক্তিদের নমুনা সংগ্রহ করছে। এছাড়াও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নমুনা সংগ্রহ করে পিসিআর ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে। আলাদাভাবে কোথাও কোনো বুথ খুলে দেওয়া হয়নি।
রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আহাদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। অনেক আক্রান্ত রোগী হাসপাতালগুলোতে আসছেন। কিন্তু আইসিইউ বেডের সংকটের কারণে কোথাও কোথাও চিকিৎসা দিতে সমস্যা হচ্ছে। বর্তমানে ২৬টি আইসিইউ বেড দিয়ে কোনোভাবে মানসম্মত এবং প্রয়োজনীয় জরুরি চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব না। আমরা আইসিইউ বেড সংখ্যা বাড়ানোসহ করোনা রোগীদের চিকিৎসার সকল সুযোগ সুবিধার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করছি আরও কিছু আইসিইউ বেড পাওয়া যাবে।
তিনি আরও বলেন, শুধু লকডাউন দিয়ে করোনা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সংক্রমণ রোধে সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য মোটিভেশন, সুপারভিশন এবং মনিটরিং কমিটি গঠন করা জরুরি। আমরা ইতোমধ্যে রংপুর বিভাগের প্রত্যেক জেলা সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের কমিটি গঠনের জন্য জানিয়েছি।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএএস