গ্রামেগঞ্জে এখনো কাউকে সাপে কাটলে ছুটে যান ওঝাদের কাছে। ঝাড়ফুঁক, গাছের শিবা (শেকড়) দিয়ে চিকিৎসা দেন ওঝারা বা কবিরাজরা। কিন্তু চিকিৎসকদের বক্তব্য, সাপে কামড়ালে কোনোভাবেই ওঝাদের কাছে না নিয়ে হাসপাতালে নিতে হবে।

পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের বদলুপাড়ার এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা সজিম উদ্দীন (৮০)। এলাকায় সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসক হিসেবে বেশ পরিচিত তিনি। কোনো তাবিজ-কবজ কিংবা ঝাড়ফুঁক নয়, সজিম উদ্দিন চিকিৎসা দেন ভেষজ উপায়ে। এ চিকিৎসাতেই গত ৫৩ বছরে তিন হাজার সাপে কাটা রোগীকে সুস্থ করেছেন এমন দাবি সজিম উদ্দীনের। এতে সহমত পোষণ করেন অনেক স্থানীয় বাসিন্দাও। সাপে কামড়ালেই এলাকা কিংবা বিভিন্ন দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন রোগীরা।

হাড়িভাসা এলাকার শরিফত আলী নামের এক উপকারভোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বাড়ির পাশে একটি পুকুরে আমার স্ত্রী মাছ ধরতে গিয়েছিল। এ সময় একটি সাপ তাকে দংশন করে। তবে জানি না কি সাপ কামড় দিয়েছিল। কামড়ের পর আমার স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে আমরা সজিম উদ্দীনের বাড়িতে নিয়ে গেলে উনার চিকিৎসাতেই আমার স্ত্রী ভালো হয়। আর কোনো চিকিৎসা করাতে হয়নি।

ঢাকা পোস্টকে স্থানীয় বানু আক্তার বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সজিম উদ্দীন খুব পরোপকারী মানুষ। সাপে কামড়ালে তার কাছে গেলে ভালো হয়ে যায়। তার ভেষজ চিকিৎসায় অসংখ্য মানুষ উপকৃত হয়েছে।

বয়স ৮০ হলেও এখনো বাইসাইকেলে চালিয়ে চলাচল করেন সজিম উদ্দিন। ঢাকা পোস্টকে সজিম উদ্দীন জানান, তিনি কোনো চিকিৎসক নন। মানুষের অনুরোধে শুধু গাছের মাধ্যমে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। গাছের গুণেই ভালো হয়েছে হাজার হাজার রোগী। রোগীর অবস্থা জটিল হলে হাসপাতালে নিতেই পরামর্শ দেন তিনি। আর কখনো তাবলিগে গেলে এ চিকিৎসা দেন তার স্ত্রী হাসিনা বেগম।

কীভাবে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন জানতে চাইলে সজিম উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেকেই আমাকে ওঝা ভাবেন। আসলে আমি কোনো ওঝা না। আমি ঝাড়ফুঁক করি না, তাবিজ দিই না। গাছগাছড়া দিয়েই চিকিৎসা করি। রোগীকে যে সাপই কামড় দিক না কেন, তার ওষুধ একটিই। আগে রোগীর সাপে কাটা স্থানে লবণ, মরিচ ও গরম পানি দিলে বুঝা যায় রোগীকে সাপে কেটেছে কি না। তা নিশ্চিত হলেই গাছের মাধ্যমে চিকিৎসা দিই। এই গাছের চিকিৎসায় আল্লাহর রহমতে রোগী সেরে উঠে। বিনিময়ে কোনো টাকা দাবি করি না, অনেকেই খুশি হয়ে কিছু দেন।

কীভাবে শিখলেন এই প্রশ্নে সজিম উদ্দীন বলেন, একাত্তর (১৯৭১) সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে গিয়েছিলাম। সেই সময় আমাকে আসামে পাঠানো হয় রেশন নিয়ে। আসামে যাওয়ার পর কুলিরা যখন রেশনের মালামাল নামাচ্ছিল, তখন কিছু মানুষকে সাপে কাটা এক রোগীকে নিয়ে পাশের বাড়িতে যেতে গেলাম। কিছুক্ষণ পর রোগীকে সুস্থ হয়ে সেই বাড়ি থেকে বের হতে দেখলে কৌতূহল জাগে। খবর নিয়ে জানতে পারলাম ওই বাড়িতে ফজলুল হক নামের একজন আলেম থাকেন। তিনি ভেষজ ওষুধে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা দেন। আমি তার কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা পদ্ধতি শিখতে আবদার করলে তিনি প্রথমে রাজি না হলেও অনেক জোরাজুরির পর তিনি আমাকে শেখান। সে চিকিৎসা পদ্ধতিতেই এলাকার মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

সজিম উদ্দীনের বড় মেয়ে বিউটি বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি বাবা সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। অনেক মানুষ উপকৃতও হয়েছে। ভালো লাগে, বাবার চিকিৎসায় মানুষদের উপকৃত হতে দেখে।

ঢাকা পোস্টকে সজিম উদ্দীনের স্ত্রী হাসিনা বেগম বলেন, আমার স্বামী যখন তাবলিগ জামাতে চলে যান তখন কোনো সাপে কাটা রোগী এলে আমার স্বামীর শেখানো পদ্ধতিতে গাছের মাধ্যমে আমি চিকিৎসা দিই। তবে রোগীর অবস্থা জটিল হলে আমরা হাসপাতালে নিতে বলি।

তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. শাকিল রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রামগঞ্জে সাপে কাটলে কিছু পদ্ধতিতে ওঝারা চিকিৎসা করে থাকেন। তবে সাপে কাটা রোগীদের জন্য পরামর্শ, যেকোনো বিষধর সাপে কাটলে দ্রত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। রোগীরা যেন না ঘাবড়ান। শরীরের যে স্থানেই কামড়াক না কেন, স্থানটি না বেঁধে, না নড়াচড়া করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। সাপে কাটলে হাত-পা শক্ত করে বেঁধে ফেলা যাবে না। একটু সচেতনতাই একজন রোগীর জীবন বাঁচাতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে।

পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন ডা. মোস্তফা জামান চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাপে কাটলে রোগীকে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু এখনো অনেকেই সেটা না করে কবিরাজ বা ওঝাদের কাছে নিয়ে যান। এ কারণে অনেক সময় সাপে কাটা রোগী চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান।

তিনি আরও বলেন, জেলা সদর হাসপাতালসহ প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যথেষ্ট অ্যান্টিভেনমসহ সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তাই সাপে কাটা রোগীদের ওঝা বা কবিরাজের কাছে না নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।

এমজেইউ