খুলনায় এই প্রথম সুগন্ধি ‘তুলশীমালা’ ধানের চাষ করা হয়েছে। স্থানীয় প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় অত্যন্ত উচ্চ মানের সুগন্ধি ধানের জাত এটি। ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলা ও আশপাশের কিছু এলাকায় কৃষকরা শখের বসে জামাই বা আত্মীয়স্বজন আপ্যায়নে এই সুগন্ধি ধান চাষ করে থাকেন। জেলার মধ্যে তুলশীমালা জাতটি গত আমন মৌসুমে প্রথম চাষ হয় বটিয়াঘাটা উপজেলার দাউনিয়াফাদ গ্রামে। পাশের গুপ্তমারী গ্রামের রণজিৎ মণ্ডল তার ৫ শতক জমিতে এই ধান চাষ করেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক এস এম আতিয়ার রহমান শখের বশে শেরপুর থেকে এই ধানের মাত্র দুই কেজি বীজ সংগ্রহ করে ওই কৃষককে দেন এবং চাষ তত্ত্বাবধান করেন।

তিনি জানান, তুলশীমালা ধান লবণাক্ত উপকূলীয় এলাকায় হবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু বাস্তবে ভালো হয়েছে। বটিয়াঘাটার স্থানীয় রানী স্যালুট, হরকোচ, কাচড়া জাতের একটি ধানের আকার ও ওজনের সমান তুলশীমালা ধানের ৩টি ধান। তুলশীমালা আকারে এতটাই ছোট এবং রং পাকলে ধানের ছড়া দেখে মনে হয় তুলশীর কাঠ দিয়ে গাঁথা মালা।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক এস এম আতিয়ার রহমান জানান, এই ধানের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ধানের ফুল আসার পর থেকে পাকা পর্যন্ত ৫ বার রং পাল্টায়। প্রথমে হালকা সবুজাভ, এরপর কিছুটা অ্যাশ, এরপর হালকা জাম রং, গাঢ় জাম রং এবং শেষে কালো ও অ্যাশ মিলিয়ে নতুন একটি রং ধারণ করে। ধানের গাছের উচ্চতা ৫০ থেকে ৫২ ইঞ্চির মতো। ধানের আয়ুষ্কাল ১১০ থেকে ১২০ দিন। একটি শিষে ৯০ থেকে ১২০টি ধান পাওয়া যায়।

তিনি জানান, ৫ শতক জমিতে দেড় মণ ধান পাওয়া গেছে। সে হিসাবে একর প্রতি ৩০ মণ ধানের ফলন হয়েছে। সব ধানই বীজ হিসেবে আগামী আমন মৌসুমে লাগানোর জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। তুলশীমালা ধান দেখে অনেকেই চাষ করতে বীজের চাহিদার কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে এ বছর ৫ থেকে ১০ জনকে কিছু বীজ দিয়ে চাষ সম্প্রসারণে সহযোগিতা করা হবে বলে তিনি জানান।

মূলত বিলুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাতের তুলশীমালা ধানকে টিকিয়ে রাখা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চাষ সম্প্রসারণ এবং উন্নত মানের চাল ব্যবহারকারী শৌখিন ক্রেতাদের জন্য এই ধানের চাষ করা হয় বলেও জানান তিনি।

অত্যন্ত প্রাচীন জাতের স্থানীয় জলবায়ুসহিষ্ণু এই ধানের চাল অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ। এ ছাড়া মূল্যবান ভিটামিন ও মিনারেলসহ অন্যান্য গুণ রয়েছে। বাজারে তুলশীমালা ধানের চাল খুব কম পাওয়া যায়। তবে ঢাকা ময়মনসিংহ বিভাগে পাওয়া যায় বেশি। প্রতি কেজি চাল ১২০ থেকে ১৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়। তুলশীমালা ধানের চালই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাবমতে, দেশে মাত্র ২০ থেকে ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে এই ধান চাষ হয়। এর শতকরা ৫০ ভাগই আবাদ হয় শেরপুর জেলায়। উচ্চফলনশীল না হলেও এই ধানের চালের কদর এখনো বেশি। সুগন্ধি কালোজিরা ধানের চালের চেয়েও আকারে ছোট সুগন্ধি তুলশীমালা ধানের চালের যেকোনো পদের খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু হয়। ধান, ধানের খড় থেকে শুরু করে মাঠময় সুগন্ধ ছড়ায়। পল্লিকবি জসীমউদদীনের কবিতায় শালি, বিন্নি ধানসহ যে কয়টি প্রাচীন সুগন্ধি উন্নত মানের ধানের উল্লেখ পাওয়া যায়, তুলশীমালা তারই একটি বলে ধারণা কৃষি বিশেষজ্ঞদের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ময়মনসিংহ অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ঢাকা পোস্টকে জানান, গত আমন মৌসুমে এ অঞ্চলে ২১ হাজার ৩০৩ হেক্টর জমিতে তুলশীমালা চাষ হয়। এর মধ্যে শেরপুর জেলায় সর্বোচ্চ ১২ হাজার ১৬ হেক্টর জমিতে চাষ হয়। হেক্টরপ্রতি চালের উৎপাদন ১ দশমিক ৫৭ মেট্রিক টন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালযের অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুল ইসলাম জানান, তার ল্যাবে এই ধান নিয়ে অধিকতর গবেষণা করে চালের কিছু বৈশিষ্ট্য অন্য কোনো জাতে প্রবেশ করানো যায় কি না, সে ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে তিনি এই ধানের বীজ সংগ্রহে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং আগামী মৌসুমে গবেষণার জন্য তা লাগাবেন এবং টিস্যু কালচারও করবেন বলে জানান।

মোহাম্মদ মিলন/এনএ