ক্রেতাশূন্য শুঁটকির আড়ত, দিশেহারা ব্যবসায়ীরা
রংপুরে করোনা মহামারির প্রথম ধাপের লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারছেন না শুঁটকি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। এরই মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের লকডাউনের ধাক্কায় কমে গেছে শুঁটকির বিকিকিনি। ঋণের বোঝার সঙ্গে লোকসানের অঙ্ক গুনে হতাশ অনেকেই। কেউ কেউ লোকসান কাটিয়ে উঠতে না পেরে ব্যবসা থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মন্দাভাব, লোকসান আর ঋণ পরিশোধ করতে না পারার চাপে অনেকেই শুঁটকি ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। ব্যবসায় ভাটা পড়ায় বর্তমানে বছরে দুই কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। এমন পরিস্থিতিতে আগামী মৌসুমেও শুঁটকিতে লোকসানের আশঙ্কা তাড়া করছে আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের।
মঙ্গলবার (৪ মে) দুপুরে রংপুর নগরীর আর কে রোডের ঘাঘটপাড়া শুঁটকি আড়তে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া যায়। এসময় চোখে পড়েনি আড়তজুড়ে শুঁটকি বেচাকেনার হাঁকডাকও।
বিজ্ঞাপন
ব্যবসায়ীদের দাবি, বাংলা বছরের অগ্রহায়ণ থেকে আশ্বিন-কার্তিক মাস পর্যন্ত শুঁটকির মৌসুম। এই সময়ে প্রতিবছর তারা (আড়তদাররা) অন্তত চার থেকে পাঁচ কোটি টাকার শুঁটকি কেনাবেচা করেন। কিন্তু এবার আড়াই কোটিও পার হয়নি। করোনাভীতি, লকডাউন আর বৈশাখী উৎসবে ভাটা― এসব কারণেই ক্ষতির সম্মুখীন বলে জানান তারা।
রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে ঘাঘটপাড়ায় এখন আর আগের মতো চলতে-ফিরতে নাকে শুঁটকির ঘ্রাণ ভেসে আসে না। আড়তের ডানে-বামে খুব বেশি দোকানও চোখে পড়বে না। গত কয়েক বছরে লোকসান সামাল দিতে না পারায় ৪২টি দোকান থেকে কমে এখন তা ১৮টিতে দাঁড়িয়েছে। এক সময় রমরমা ব্যবসা ছিল আড়তজুড়ে। কিন্তু এখন শুঁটকির মৌসুমেও ক্রেতা নেই। আগের মতো দূরদূরান্ত থেকে আসা পাইকারদের আনাগোনাও চোখে পড়ে না। বর্তমানে হাতে গোনা চার-পাঁচ জন বড় আড়তদার এই শুঁটকি ব্যবসা ধরে রেখেছেন। কিন্তু তারাও আছেন লোকসানের ঝুঁকিতে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা গেছে, বস্তায় বস্তায় সাজানো চ্যালা, লইট্যা, ফ্যাসা, কাচকি, ভেটকিসহ নানা জাতের সামুদ্রিক ও দেশি মাছের শুঁটকি আড়তজুড়ে। ক্রেতার চাপ না থাকায় শুঁটকি পরিচর্যায় ব্যস্ত অনেক ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আমদানি করা অন্তত ৪০ প্রকারের শুঁটকি এই আড়তে পাওয়া যায়।
এ ছাড়া রংপুর জেলাসহ লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া ও রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা এখান থেকে পাইকারি দরে শুঁটকি কিনে থাকেন। কিন্তু লকডাউন পরিস্থিতিতে এখন সেই পাইকারদের দেখা মিলছে না আড়তে।
শুঁটকির আড়তে কথা হয় সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। বছরখানেক আগে বস্তায় সংরক্ষণ করা বেশকিছু নষ্ট শুঁটকি বাছাই করছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকায় কিছু শুঁটকি গুঁড়া হয়ে গেছে। এতে তার লোকসানের অঙ্কটা বেড়ে যাবে বলে জানান তিনি। ঢাকা পোস্টকে বলেন, রমজান মাস, সঙ্গে করোনা ও লকডাউন চলছে। আগের মতো কাস্টমার নেই। বেচাবিক্রি একেবারেই কম। দোকানে দীর্ঘদিন ধরে শুঁটকি পড়ে থাকায় শুঁটকির ওজন কমে গেছে। অনেক বস্তার শুঁটকি নষ্ট হয়ে গেছে।
শুঁটকি কিনতে আসা হারুন অর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামুদ্রিক বড় মাছের দুই কেজি শুঁটকি কিনলাম। এই শুঁটকি এক মাস খাওয়া যাবে। বেশ সুস্বাদু হওয়ায় মাসে অন্তত একবার হলেও আড়তে এসে পছন্দমতো শুঁটকি কিনি। তবে করোনার কারণে এখন খুব বেশি আসা হয় না। দুই মাস পর এসে শুঁটকি কিনলাম। কিন্তু আগে যে দোকান থেকে কিনতাম, এখন সেই দোকান বন্ধ। শুনলাম ব্যবসা বদল করে অন্যত্র চলে গেছে।
বহু পুরোনো আড়তদার লুৎফর রহমান। প্রতিদিন তার ক্যাশে লাখ টাকার হিসাব হতো। কিন্তু গেল কয়েক বছর ধরে পুরো পরিস্থিতি উল্টো। এখন মাসেও লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, মৌসুমে প্রতিদিন অন্তত ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি হতো। এখন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার ওপরে বেচাকেনা নেই। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে ব্যবসায় দুর্দিন যাচ্ছে। গেল দুই বৈশাখে লকডাউন ও সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের কারণে পয়লা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠান হয়নি। এতে আমাদের শুঁটকির ব্যবসার ক্ষতি হয়ছে।
এই ব্যবসায়ীর মতে, ঘাঘটপাড়ার চারজন আড়তদার প্রতিবছর পাঁচ কোটি টাকার ওপরে শুঁটকি বেচাকেনা করতেন। কিন্তু এখন শুঁটকি ব্যবসায় ধস নেমেছে। বেচাকেনা নেই। আগের মতো পাইকাররাও আসেন না। এখন বছরে এক থেকে দেড় কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। খুচরা-পাইকারি মিলে দিনে যেখানে এক থেকে দেড় লাখ টাকা বিক্রি হতো, সেখানে ১৫ হাজার টাকাও হয় না।
শুঁটকি ব্যবসায়ী আজগর আলী বলেন, ব্যবসার পরিস্থিতি এত খারাপ হবে, আগে ভাবতে পারিনি। দিন দিন বাকি বিক্রির পাল্লা ভারী হচ্ছে। সঙ্গে লোকসান তো লেগেই আছে। এ কারণে অনেকেই ব্যবসা বদল করেছেন। এখন বছরের বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত একটু বেচাকেনা ভালো হয়। বাকি সময়টা কোনো রকমে চলে। এভাবে চলতে থাকলে শুঁটকি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে বিকল্প ভাবতে হবে।
শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজিজ শেখ ঢাকা পোস্টকে জানান, বর্তমানে শুঁটকি ব্যবসায়ীদের শোচনীয় দিন যাচ্ছে। ব্যবসায় মন্দা পরিস্থিতির কারণে অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছেন। সর্বশেষ ঘাঘটপাড়ায় ১৪ জন পাইকারি দোকানদার আর ৪ জন আড়তদার রয়েছেন। সবার একই অবস্থা। করোনার প্রভাব, বৈশাখী উৎসব না হওয়াসহ ব্যাংকঋণ-সুবিধা না পাওয়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমনটা চলতে থাকলে আগামী মৌসুমেও শুঁটকির ব্যবসায় লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে।
এনএ/জেএস