পরিবহন বন্ধ। তাই ট্রাকে করে বাড়ির পথ ধরেছেন তারা

‘মাও-বাপ, বউ-ছাওয়া সগায় গ্রামোত থাকে। মুই ঈদের ছুটিত ঢাকাত থাকি কী করিম? সরকার করোনার কতা কয়া মানুষোক তো কম কষ্ট দেওচে না। বাস-ট্রেন ছাড়া সোগে সচল আছে। এ্যলা কামাই করা অর্ধেক টাকা খরচ করি বাড়ি যাওচি। কিন্তু রাস্তাত যতবার পুলিশ গাড়ি থামাইছে, এটা খুব কষ্টের। হামার মতো গরিব মানুষোক কষ্ট দিয়্যা সরকারের লাভ কী? যায় (যে) যেমন করি পায় বাড়ি যাউক। হামার আর ফটো তোলেন না।’
 
কথাগুলো বলছিলেন ৪৮ বছর বয়সী ফরিদুল ইসলাম। ট্রাকে করে ঢাকার সাভার থেকে গ্রামের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জে ফিরছিলেন এই সবজি বিক্রেতা।

মঙ্গলবার (১১ মে) দুপুরে রংপুর নগরের রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ মোড়ে কথা হয় ফরিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি সাভারের শিল্পকারখানা এলাকায় ভ্যানে করে কাঁচা শাকসবজি বিক্রি করেন।

ঢাকা পোস্টকে ফরিদুল বলেন, বাস বন্ধ থাকলে কী হইবে? গোটা রাস্তাত তো গাড়ি দিয়্যা ভর্তি। ঢাকাত থাকি মরমো নাকি? যাই যেমন করি পাওচে বাড়ি যাওচে। মুই দুইবার ট্রাক চেঞ্জ করি রংপুরোত আসনু। এই ঘাটা কোনা আসতে ২৬০০ টাকা খরচ করনু। এক মাসের তরকারি (সবজি) বিক্রি করে লাভ হইছে হাজার দশেক টাকা। বাড়ি আসতে সেই টাকার অর্ধেকে শ্যাষ।

তিনি বলেন, খালি মুই নোয়ায়, জীবনের ঝুঁকি নিয়্যা ঢাকা থাকি সগায় (সবাই) গ্রামোত যাওছে। পুলিশ গাড়ি থামাওচে। কোনোটে ফির গাড়ি থাকি নামি দেওচে। কিন্তু টাকা দিলে সোগে জায়েজ।

এই সবজি বিক্রেতার মতো হাজারো মানুষ সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামের বাড়ি ছুটছেন। দূরপাল্লার বাস-ট্রেন বন্ধ থাকলেও ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখী মানুষকে থামানো যাচ্ছে না। এখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি ভাড়ায় ট্রাক-পিকআপ-মাইক্রোবাস অ্যাম্বুলেন্সে গাদাগাদি করে ছুটছে মানুষ। এ চিত্র শুধু দিনের বেলায় নয়, রাতে, ভোরে, সকালে যে যেভাবে পারছেন, ফিরছেন নিজ গন্তব্যে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুর নগরের প্রবেশদ্বার রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের মডার্ন মোড়, সাতমাথা, মেডিকেল মোড়ে, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন পয়েন্টে মানুষের স্রোত। বাড়তি ভাড়া দিয়ে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে-বসে-শুয়ে, আবার কেউবা জড়োসড়ো হয়ে ট্রাক-পিকআপ-মাইক্রোবাসে ভর করছে সবাই। কেউ কেউ কাভার্ড ভ্যানে করেই ধরেছেন গন্তব্যের পথ। স্বাস্থ্যবিধি তো বহুদূর, রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটলে কী হবে, সেটাও তোয়াক্কা করছেন না কেউ। অনেকে আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সড়কে পুলিশ চেকপোস্ট থাকলেও মানুষের স্রোত ঠেকাতে নামমাত্র চেষ্টা করছে তারা।

মডার্ন মোড়ে চোখে পড়ে, একটি কাভার্ড ভ্যানে অন্তত ২০ জন গাদাগাদি করে যাচ্ছে। তারা নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামে যাচ্ছিলেন। ভ্যানচালক ইব্রাহিম বলেন, সামর্থ্যবান মানুষেরা ব্যক্তিগত যানবাহনে গ্রামের বাড়ি ফিরছে। কিন্তু যাদের উপায় নেই, তারা তো এভাবেই ফিরবে। ভাড়া সবাই বেশি নিচ্ছে। আমরা তো ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি। পথেঘাটে চাঁদা দিতে হয়। এখন বাস-ট্রেন না থাকায় আমাদের ওপর চাপ বেড়েছে। মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যানজটও সৃষ্টি হয়েছে, পথে পথে ভোগান্তি।

ওই কাভার্ড ভ্যানের যাত্রী মোখলেছুর রহমান বলেন, লেগুনা, ট্রাক কিংবা মোটরসাইকেলে চড়ে অনেকেই দুই-তিন গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন। এমনকি অনেকে পায়ে হেঁটেও লম্বা পথ পাড়ি দিচ্ছেন। ঢাকায় এক দিন থাকা মানে হাজার টাকা খরচ। এ জন্য ছুটির সময় বাড়িতে ঈদ উদযাপন করতে কষ্ট করে গ্রামে যাচ্ছি। ভাড়া বেশি লাগছে সত্য, কিন্তু উপায় নেই। নারায়ণগঞ্জ থেকে রংপুর শহরে ঢুকতে প্রায় ১৮ ঘণ্টা সময় লাগল।

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের দিকে যাওয়া মাইক্রোবাসের ড্রাইভার আতিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাজীপুর টঙ্গী থেকে ১৭ জন যাত্রী নিয়ে রওনা হয়েছে। পথিমধ্যে পুলিশের কারণে আটজনকে মাঝপথে নামিয়ে দিয়েছেন। বাসের তুলনায় ভাড়া বেশি নেওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, জনপ্রতি যাত্রী ২ হাজার টাকা থেকে ২৬০০ টাকা দিয়েছেন। আমরা খুব বেশি ভাড়া নিচ্ছি না। তবে নীলফামারী থেকে ফিরতি ভাড়া না পেলে আমার ক্ষতি হবে।

কয়েক দিন ধরে রংপুরসহ এর আশপাশের জেলার মানুষেরা ঢাকায় থেকে দুই-তিন গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে ট্রাক-পিকআপ-মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের পথে ফিরছেন। এসব মানুষের মধ্যে পোশাক কারখানার শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালক ও ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালাসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরাই বেশি। তবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষরাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট ও ভোগান্তি শিকার করে বাড়ি ফিরছেন।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এনএ