বৃহস্পতিবার (১৩ মে) প্রথম প্রহর, সময় তখন রাত পৌনে ২টা। সেহেরীর খাবার কেনার জন্য বগুড়া শহরের সাতমাথায় খাবারের হোটেলের খোঁজ করছেন কয়েকজন। শহরের মেরিনা মার্কেট রোডে খোলা একমাত্র খাবার হোটেল থেকে ভাত, ডাল, ডিম ও পানি কিনলেন তারা। এর মধ্যে শাওন হোসেন নামে একজনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ট্রাকে করে রাজধানী ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে রংপুরের মিঠাপুকুরে ঈদ করতে যাচ্ছেন।

শাওন হোসেন পেশায় গার্মেন্টস কর্মী। রাজধানী ঢাকার আশুলিয়ায় নামকরা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কোয়ালিটি কন্ট্রোলারের চাকরি করেন। শাওনের সঙ্গে স্ত্রী শারমীন আক্তারও রয়েছেন, তিনিও একই গার্মেন্টসে কাজ করেন পোশাক শ্রমিক হিসেবে। তাদের সঙ্গে রয়েছে দেড় বছরের মেয়ে কুলসুম আক্তার। শাওন হোসেন বিকেল ৩টার দিকে রওনা করেছেন পরিবার নিয়ে আশুলিয়া ট্রাক স্ট্যান্ড থেকে। সস্ত্রীক ট্রাকের পাটাতনে কাপড় বিছিয়ে এসেছেন পুরো পথ। 

তিনি জানান, চার দিনের ছুটি পেয়েছেন। প্রতিবারের মতো ঈদের জন্য জমানো টাকা থেকে মা-বাবার জন্য শাড়ি-লুঙ্গি, ছোট ভাইবোনের জন্য জামা কাপড়, ঈদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেছেন। কষ্ট করে বাড়ি যাচ্ছেন, তবুও তা যেন তার কাছে কষ্টই নয়। মা-বাবা ও পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারবেন, এটিই বড়। বললেন, ‘নাড়ির টান বলে কথা।’

ট্রাকের কাছে গিয়ে দেখা যায়, শাওনের স্ত্রী শারমীন আক্তার মেয়ে কুলসুমকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন ট্রাক থেকে নেমে। কুলসুম কান্না করছে, তাকে শান্ত করতে ব্যস্ত শারমীন। কথা হয় শারমিন আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে ঈদ করবেন। পর দিন বাবার বাড়িতে যাবেন। তাই কষ্ট করে বাড়ি ফেরাতে কোনো ক্লান্তি নেই তার। তবে মেয়ে ছোট, তাই একটু কষ্ট হচ্ছে।

শাওন জানালেন, আশুলিয়া থেকে দুজন ১৬০০ টাকা দিয়ে উঠেছেন ট্রাকে। জনপ্রতি ভাড়া দিতে হয়েছে ৮০০ টাকা করে। তবুও যেন তার দেহে কোনো ক্লান্তি নেই। প্রতিবছর শাওন তার পরিবার নিয়ে বিআরটিসি বাসে করে ঢাকার আশুলিয়া থেকে রওনা হন। আবার সেই বাসেই ফিরে যান ছুটি শেষে। দলবেঁধে আসেন, আবার দলবেঁধে কর্মে ফিরে যান। এবার করোনায় বাস ছাড়ার সুযোগ না থাকায় পরিবারের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করার স্বপ্ন নিয়ে ট্রাকের পাটাতনে বসেই যেতে হচ্ছে বাড়ি।

শাওনের সঙ্গে ওই ট্রাকে উঠেছেন ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৩৫ জন যাত্রী। প্রত্যেকেরই ভাড়া ৮০০ টাকা করে। ট্রাক চালক শিপন জানান, বছরে এমন ভাড়া হয় কম। এবার ঈদে বাস নেই। তাই বেশি ভাড়ায় যাত্রী পেয়েছেন। করোনার ভয় বলে কিছু নেই। করোনা যার হওয়ার তার হবে। মানুষ বাড়ি ফিরবে ঈদ করতে, তাদেরও ভালো আয় হচ্ছে। ট্রাকের মালিককেও বেশি টাকা দিতে পারবেন।

গতবছর ঈদে কেমন যাত্রী ও ভাড়া পেয়েছিলেন? জানতে চাইলে শিপন জানান, গতবছর যারা ঢাকা থেকে বগুড়া পর্যন্ত এসেছেন, তখন জনপ্রতি ভাড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা নিয়েছেন। এবার করোনায় বাস ছাড়েনি, তাই জনপ্রতি ৮০০ টাকা করে নিচ্ছেন।

ওই ট্রাকের আরেক যাত্রী রমজান আলী। বাড়ি যাচ্ছেন মা বাবার সঙ্গে ঈদ করতে। তিনি জানান, মায়ের সঙ্গে ঈদ করাটা অনেকটা কিছু স্বপ্নের মতো। রমজান আলী ভাবেননি এবার ঈদ করতে পারবেন পরিবারের সঙ্গে। ছোট বেলায় ৯ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই জীবন যুদ্ধে নেমে যান তিনি। এবার এখনও মায়ের জন্য কেনাকাটা করেননি। বাড়ি গিয়ে মায়ের জন্য কেনাকাটা করবেন। বোনকে দাওয়াত করবেন বাড়িতে আসতে। একমাত্র ভাগ্নির জন্য কিনেছেন লাল জামা। 

রমজান আলী আগে এলাকায় ভ্যান রিকশা চালাতেন। কোনোরকমে মাকে নিয়ে চলতেন। এখন আগের থেকে ভালো চলছে তার পরিবারের। যদিও মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকেন। তবুও মায়ের জন্য দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছেন, এতেই তার প্রশান্তি।

শাওন ও রমজানের মতো ওই ট্রাকে থাকা রিপন, মানিক, সালাম, শহিদুল, কুদ্দুস, আলী হোসেনসহ অন্য যাত্রীদের দেহে ক্লান্তি দেখা গেলেও চোখেমুখে যেন একমুঠো স্বপ্ন দেখা গেল। এই স্বপ্ন স্বজনের কাছে ফেরার, আনন্দ ভাগাভাগি করার। কারণ বাড়িতে কারও জন্য অপেক্ষা করছেন মা-বাবা, কারও ছেলে-মেয়ে, কারওবা প্রিয়জন। সেই অপেক্ষার প্রহর শেষে একসঙ্গে সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন এমন প্রত্যাশায় পথ চলছেন তারা।

সাখাওয়াত হোসেন জনি/এসএসএইচ