‘ফেরিতে যারা মারা গেছে, পানি খাইয়াও মরতে পারে নাই’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকারি নির্দেশনায় দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। এতেই যত ভোগান্তি ঈদে ঘরমুখো মানুষের। পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটাতে অজস্র মানুষ নানা কায়দায় ছুটছেন বাড়ির দিকে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ মানুষ বাড়িতে পৌঁছে গেছেন। আবার অনেকে দীর্ঘ ভোগান্তির পথ পারি দিচ্ছেন। যে যেভাবেই আসুক অনেকটা যুদ্ধ করেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে। ঘরে ফেরা মানুষদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এবারের ঈদযাত্রার বাজে অভিজ্ঞতার কথা।
এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে রাজধানীর লালবাগের রয়েল রেস্তোরাঁয় কাজ করা জামাল মিয়ার। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার পাতারহাট বন্দর সংলগ্ন এলাকায় তার বাড়ি। তারই বন্ধু টিটু কাজ করেন ঢাকার বিমানবন্দর এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।
বিজ্ঞাপন
বরিশাল নদী বন্দরে বুধবার (১২ মে) রাত সাড়ে ৯টার দিকে কথা হয় তাদের সঙ্গে। জামাল বলেন, ধরতে পারেন এক ধরনের হেঁটেই এসেছি বরিশালে। ঢাকা থেকে বাসে মাওয়া এসেছি ১০০ টাকা ভাড়ায়। সেখানে এসে কমপক্ষে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে একটি চরে গিয়ে ট্রলারে উঠবো ঠিক তখনই পুলিশ হাজির।
‘মনু যাবা কই, আর রক্ষা নাই। কী মাইরডাই না দিলো আমাগো। প্রত্যেক যাত্রী ধইরা ধইরা পিডাইছে’ বলতে বলতে হাটুর ওপরে কাপড় তুলে দেখিয়ে জামাল বলেন, আমারে যে পিডানডা দিছে তা একটু বেকায়দার। মানষেরে দেখাইতে পারি না। বেন বেলা পিডাইছে, এহনও ফুইল্যা আছে।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, ওই ট্রলারে আর উঠতে পারি নাই। শ্যাষে চরে বইয়া রইলাম তিন ঘণ্টা। সকাল ১০টার দিকে আরেকটা ট্রলারে উঠছি। ট্রলারটা কাঠের। যাত্রী কম হলেও সত্তর জন হবে। শ্যাষে ভয়ে নেমে আরও এক ঘণ্টার অপেক্ষার পর আরেকটা বড় ট্রলারে উঠি। ট্রলারটা কমপক্ষে একশ যাত্রী নিয়ে আড়াইটার দিকে পদ্মা পার হয়ে এপারে ওঠে।
জামাল বলেন, ৪০০ টাকা ট্রলার ভাড়া দিয়ে এপারও পন্টুনে নামতে পারিনি। আরেকটি চরে নামিয়ে দিয়েছেন ট্রলার চালক। সেখান থেকে তিন কিলোমিটারের মত হেঁটে গাড়ির কাছে এসেছে। ৪০০ টাকা জনপ্রতি দিয়ে পিকআপ ভ্যানে সন্ধ্যায় বরিশাল এসে নেমে লঞ্চঘাটে অপেক্ষা করছি।
জানা গেছে, বরিশাল নদী বন্দর থেকে রাত সাড়ে তিনটা থেকে ৪টার মধ্যে বেশ কয়েকটি ট্রলার মেহেন্দীগঞ্জ ও ভোলার উদ্দেশে যাত্রী নিয়ে যাবে। সেই ট্রলারের অপেক্ষায় তারা রয়েছেন।
তবে জামালের বন্ধু টিটুর সঙ্গে দেখা হয় মাওয়া ঘাটে। তিনি অবশ্য পদ্মা পার হয়েছেন ফেরিতে। সেজন্য তার খরচ কম হয়েছে উল্লেখ করে টিটু বলেন, যে ফেরিতে মানুষ মারা গেছে সেই ফেরিতে আমি ছিলাম। ওই ফেরিতে কমপক্ষে মানুষ ছিল ১০ হাজার। মানুষ যে কত অসহায় তা ফেরিতে না উঠলে বুঝতাম না। মানুষ যখন দেখছি চোখের সামনে মরে যাচ্ছে তখন বুঝছি আসলে না আসা উচিত ছিল। কিন্তু কী করবো, মনতো মানে না।
‘এইডা আসলে ঈদ না, মরণযাত্রা’ উল্লেখ করে টিটু বলেন, বড় আফসোস আমার। ফেরিতে যারা মারা গেছে তারা পানি খাইয়াও মরতে পারে নাই। পায়ের নিচে পইরা মরছে।
বরিশাল নদী বন্দরের পন্টুন ঘুরে দেখা গেছে বেশ কয়েকটি জটলায় প্রায় দুই শতাধিক মানুষ অপেক্ষা করছে। রাত গভীর হলে মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ, মাসকাটা, কীর্তণখোলা, কালাবদরের মত ভয়ঙ্কর নদী পার হওয়ার কথা তাদের।
জানা গেছে, বরিশাল নদী বন্দরের ইজারাদাররা অত্যন্ত গোপনে তিনদিন ধরেই স্পিডবোট ও ট্রলার ছাড়ছেন গভীর রাতে। এছাড়াও স্টিমার ঘাট থেকেও যাত্রীবোঝাই ট্রলার ছাড়ার অভিযোগ রয়েছে।
যদিও বরিশাল সদর নৌ-থানার এসআই অলক চৌধুরী জানান, বরিশাল নদী বন্দর ও এর আশপাশের এলাকা থেকে ট্রলার ছাড়ার কোনো সুযোগ নেই। পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কেউ নিয়ম অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হবে।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর