বিক্রেতারা পার করছেন অলস সময়

দেশের সবচেয়ে বড় আমবাজার চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট আমবাজারে বছরের অন্যান্য মৌসুমে একই সময়ে আমে ভরপুর থাকে। এ সময় বাজারে তিল ধারনের ঠাঁই হয় না। আমে কানায় কানায় পূর্ণ থাকে বাজার। পাকা, আধপাকা আমের সুমিষ্ট ও ম-ম গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পুরো আধা কিলোমিটার এলাকার বাজারে। কিন্তু এবারের চিত্র পুরোই ভিন্ন। চলমান লকডাউনের কারণে বেপারিরা আসতে না পারায় কানসাট আমবাজারের নেই কোনো ক্রেতা। ফলে বিক্রেতারা অলস সময় পার করছেন।

জানা যায়, দেশের একমাত্র পাকা আমের বাজার কানসাটের স্থানীয় আমচাষি, ব্যবসায়ী, আড়তদার ও রফতানিকারকরা অপেক্ষায় থাকেন বছরের এই সময়ের জন্য। আমচাষিরা সারা বছর বাগান পরিচর্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বছরের পুরো সময় শূন্য দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার দুই ধারের আড়তগুলো। কারণ, আমের মৌসুমে আড়াই-তিন মাসের ব্যবসাই আড়তদারদের প্রধান ভরসা। কিন্তু এই মৌসুমে বাজার চালুর সপ্তাহ খানেক পার হয়ে গেলেও নেই কানসাট আমবাজারের আগের সেই চিরচেনা দৃশ্য।

স্থানীয় আমচাষি, ব্যবসায়ী, আড়তদার ও রফতানিকারকরা বলছেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ, মৃত্যু ও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট রোধে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলমান কঠোর লকডাউনের কারণেই এই করুণ দৃশ্য ঐতিহ্যবাহী কানসাট আমবাজারের।

তারা জানান, কানসাট আমবাজারের প্রায় ৭০ শতাংশই কিনে নিয়ে যান বেপারিরা। কঠোর লকডাউনে সারাদেশের সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বিচ্ছিন্ন ও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এ বছর তারা আসতে পারছেন না। ফলে বাজারে গোপালভোগ ও গুটি জাতের আমের বাজার ফুরিয়ে এলেও অনেক চাষি আম পাড়ছেন না।

এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিআই (জিওগ্রাফিকেল ইন্ডিকেশন) পণ্য সবচেয়ে সুমিষ্ট ক্ষীরশাপাত আম আসতে শুরু করেছে বাজারে। এতে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন আম-সংশ্লিষ্টরা। বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আগাম জাতের আমচাষিরা।

রোববার (৩০ মে) কঠোর লকডাউনের ষষ্ঠ দিন চলছে। চলমান লকডাউনের মেয়াদ বাড়ালে আমের ব্যবসায় স্মরণকালের ধস নামবে বলে মনে করেন আম ব্যবসা-সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, শিবগঞ্জ-সোনামসজিদ সড়কের কানসাট বাজারের রাস্তার দুই ধারে প্রায় ৩০০ আমের আড়ত। এর মধ্যে খুলেছে মাত্র ১৫ থেকে ২০টি। আমের ক্রেতা না থাকায় অনেকেই চালু করতে চাইছেন না আমের আড়ত। অন্যান্য বছরে এ বাজার থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ থেকে ১০০ ট্রাক আম যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কিন্তু এখন ১০ থেকে ১২ ট্রাক যাচ্ছে। এসব আমও বেশির ভাগই সংগ্রহ করা হচ্ছে বাগান থেকে।

কানসাট বাজারে গোপালভোগ আম ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা, ক্ষীরশাপাত ১৫০০ থেকে ২২০০ টাকা ও গুটি জাতের আম ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

ছয় দিন আগে কানসাট বাজারে আড়ত চালু করেছেন ডিয়ার ফল ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী দোস্ত মোহাম্মদ দোসু। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, অনেক ভয়ে ভয়ে আড়ত খুলেছি। ছয় দিন হয়ে গেল, তাও আড়তে আম নাই। অথচ গাছে গাছে ঝুলছে আম। পরিপক্বতা এসেছে। কিন্তু আমচাষিরা আম পাড়ছেন না। কেন পাড়ছেন না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কঠোর লকডাউনে বাইরে থেকে বেপারিরা আসতে পারছেন না। তারা না এলে কে আম নেবে? তারাই তো সব আম কেনেন।

হিমেল ফল ভান্ডারের মালিক মো. সেমাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, এ বছর শুরু থেকেই লোকসান গুনতে হচ্ছে। ক্রেতা না থাকলে আম নিয়ে কী করব? কয়েক দিন থেকে আড়তে বসে আছি। আমচাষিরা আম নিয়ে আসছেন না। বাইরের ক্রেতা না আসায় দামও অনেক কম।

শিবগঞ্জ উপজেলার মর্দানা গ্রামের আমচাষি রুবেল আহমেদ বলেন, প্রায় ছয় লাখ টাকা দিয়ে বাগান কেনা আছে। গাছেই আম পাকতে শুরু করেছে। পাড়তে পারি না বলে বাগানেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলেও জানান তিনি।

শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিডেটের সাধারণ সম্পাদক ও আম রফতানিকারক ইসমাঈল খান শামিম ঢাকা পোস্টকে জানান, এ বছর আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। তারপরও কৃষকরা আমের ন্যায্যমূল্য নিয়ে শঙ্কিত। জেলার আমভিত্তিক বিশাল অর্থনীতির স্বার্থে নীতিনির্ধারণী মহলের কাছে আবেদন এ ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার। বেপারিদের আসার জন্য বিশেষ মুভমেন্ট পাস, তাদের নিয়ে আসা, হোটেলে থাকা ও কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করতে পারলে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

কানসাট আম আড়তদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক টিপু বলেন, অনলাইনে আম বিক্রির কথা বললেও তা সম্ভব নয়। কেননা, অনলাইনে মাত্র পাঁচ ভাগ আম বিক্রি হয়ে থাকে। বাকি ৯৫ ভাগ আম এ বাজার থেকেই বিক্রি হয়। বাইরের বেপারিরা না এলে কানসাট বাজার জমবে না।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাকিব-আল-রাব্বী জানান, কানসাট বাজারে করোনা বা কঠোর লকডাউনের যাতে কোনো প্রভাব না পড়ে, সেই লক্ষ্যে কাজ করছে প্রশাসন। শুরু থেকেই কঠোর লকডাউনের আওতার বাইরে রয়েছে কৃষিজাত পণ্য ও আম পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ডা. শামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রশাসনের আয়োজনে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বেপারিদের জন্য করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের জন্য বিশেষ কয়েকটি হোটেলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেখানে অবস্থান করে তারা নিরাপদে আমের ব্যবসা করতে পারবেন।

উল্লেখ্য, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন ঘোষিত জেলায় কঠোর লকডাউন গত মঙ্গলবার (২৫ মে) থেকে শুরু হয়ে চলবে সোমবার (৩১ মে) রাত ১২টা পর্যন্ত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচটি উপজেলায় এ বছর প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। এসব বাগানে প্রায় ২৭ লাখ গাছ থেকে আড়াই লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।

মো. জাহাঙ্গীর আলম/এনএ