জন্মের পর থেকেই পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ হয়নি অঞ্জনার। তবু জীবন-সংগ্রামে দমে যাননি তিনি। অনেক কষ্ট করে শেষ করেছেন পড়াশোনা। দরিদ্র পরিবারে সচ্ছলতা আনতে এরই মধ্যে বসেছেন বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায়। কিন্তু ভালো ফল করলেও প্রতিবন্ধী হওয়ায় চাকরি জোটেনি তার কপালে। তাতে কী! তবু হাল ছাড়েননি। টিউশনি ও গান গেয়ে অর্থ আয় করে পরিবারের হাল ধরেছেন তিনি।

কুষ্টিয়া জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র আমলাপাড়া এলাকার বিবি নন্দি রোডের পুরাতন আনসার অফিসের সরকারি জায়গায় বাস করেন অঞ্জনা। তার বাবা ফুটপাতের চা বিক্রি করেন। পরিবারে তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে অঞ্জনা সবার বড়।

দৃষ্টিহীনতা আর দারিদ্র্যের সঙ্গে একই সঙ্গে লড়াই করে ইতিহাস বিভাগে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। অদ্যম মনোবল নিয়ে এখন চালিয়ে যাচ্ছেন জীবনযুদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে তিনি চাকরির পড়াশোনা, সাংসারিক কাজ, টিউশনি, গানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়াসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

২০০৬ সালে কুষ্টিয়া হাইস্কুল থেকে এসএসসিতে ভালো ফল করে ভর্তি হন ইসলামীয়া কলেজে। সেখান থেকে ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৩ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ইতিহাস বিভাগে অনার্স ও ২০১৪ সালে মাস্টার্স মাস্টার্স পাস করেন অঞ্জনা।

অঞ্জনা রানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভাব-অনটন আর দৃষ্টিহীনতার মধ্যে বেড়ে উঠতে হয়েছে। পদে পদে সংকট আর সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কিন্তু আমি কোনো দিন থেমে যাইনি। মনোবল নিয়ে বাস্তবতার সঙ্গে লড়ছি। মা-বাবার সহযোগিতা ও আমার নিরলস কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এত দূর পৌঁছেছি। আমি মাস্টার্স পাস করেছি, তবু চাকরি হচ্ছে না। কারণ, আমি প্রতিবন্ধী।

তিনি বলেন, এখন একটা সরকারি চাকরি চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। আমি তার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ চাই, তাকে জীবনযুদ্ধের গল্প শুনিয়ে একটি সরকারি চাকরি চাইব। চাকরি পেলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পাশাপাশি পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে চাই।

মা-বাবার সঙ্গে অঞ্জনা

অঞ্জনা বলেন, কয়েক বছর আগে সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী চা দোকানি বাবা মান্দারী হালদার সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। এখন তিনি চলাচল করতে পারেন না। এ কারণে সংসারে অভাব-অনটন আরও বেড়েছে। কয়েকটি টিউশনি করে সংসারের হাল ধরেছি আমি। তবে অনেকেই আমার কাছে ছেলেমেয়েদের পড়াতে চান না। গান শেখাতেও চান না। সমাজের মানুষ অন্য চোখে দেখে আমাকে। তাই আমার প্রত্যাশা যোগ্যতানুযায়ী একটি সরকারি চাকরির।

অঞ্জনার মা ফুলমালা হালদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জন্মের পর থেকে আমার অঞ্জনা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার বয়সে প্রথমে তাকে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করি। স্কুলে ভর্তি করার পর প্রতিবেশীরা যেমন নানা রকম টিপ্পনী কাটত, শিক্ষকরাও কথা শোনাতে ছাড়তেন না। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি, অভাব-অনটনসহ নানা সংকটের মধ্যেও অঞ্জনাকে নিয়ে স্কুলে যেতাম। ছোট থেকেই অঞ্জনা খুব মেধাবী ছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি অঞ্জনা গান, ইসলামিক গজল, উপস্থিত বক্তৃতায় পারদর্শী ছিল। কৃতিত্বের সঙ্গে স্কুল, কলেজে ভালো ফলাফল অর্জন করেছে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, আমার মেয়ের জন্য একটা সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।

অঞ্জনার বাবা মান্দারী হালদার বলেন, অঞ্জনার চোখে আলো না থাকলেও ছোটবেলা থেকে নিজের কাজ নিজে করার চেষ্টা করত। তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও অদম্য আগ্রহ তাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। সে অন্যান্য স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের মতো অনার্স-মাস্টার্স পাস করেছে। নিজে মোবাইল চালায়। নিজের হাতে খাওয়াদাওয়া করে। সংসারের কাজ করে। আমার মেয়ের জন্য সরকারের কাছে একটি চাকরি চাই। অঞ্জনার একটা চাকরি হলে আমাদের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।

অদম্য মেধাবী অঞ্জনা রানীর প্রতিবেশীরা বলেন, অঞ্জনা তার মা-বাবার প্রথম সন্তান। জন্ম থেকেই সে চোখে দেখে না। অঞ্জনার মা খুব কষ্ট করে অঞ্জনাকে পড়াশোনা শিখিয়েছেন। কারণ তারা খুবই তারা খুবই দরিদ্র। নুন আনতে পান্তা ফোরায় অবস্থা।

কুষ্টিয়া পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এস এম আতাউল গনি ওসমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অঞ্জনা নামের মেয়েটিকে আমি চিনি এবং জানি। সে আমার এলাকার বাসিন্দা ছোট থেকে খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে। কয়েক বছর হলো সে মাস্টার্স শেষ করেছে কিন্তু এখনো কোনো চাকরির ব্যবস্থা হয়নি। সরকার যদি তার পাশে দাঁড়ায়, তাহলে পরিবারটি কষ্ট দূর হবে। আমরা চাই সরকার তার পাশে দাঁড়াক।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাধন কুমার বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারি চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা তো আমাদের নেই। কারণ, সরকারি চাকরি একটা নিয়ম-নীতি মেনে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেওয়া হয়। যদি আমার ক্ষমতার ভেতরে থাকত, তাহলে অবশ্যই মেধাবী অঞ্জনার রানীর পাশে দাঁড়াতাম। আমি তার সার্বিক মঙ্গল কামনা করি।

এনএ