অ্যাডভোকেট মো. জয়নাল আবেদীন সিকদার

বাবা মানে ভরসাস্থল। বাবা মানে পথপ্রদর্শক। অনুশাসনের দ্বিতীয় নামটিও কেবল বাবা। এক বাবা ১০০ শিক্ষকের সমান। বাবা মানে আশ্রয়-প্রশ্রয় আর শত শাসনের পরও যেন নীরব ভালোবাসা। আবার পৃথিবীতে একমাত্র বাবাই এমন এক ব্যক্তি, যিনি নিজের চেয়ে নিজের সন্তাকে এগিয়ে যেতে দেখতে চান।

আজ (২০ জুন) বাবা দিবসে বৃদ্ধ বাবা অ্যাডভোকেট মো. জয়নাল আবেদীন সিকদার তার সন্তানদের কথা জানিয়েছেন। সেই গল্প তুলে ধরেছে ঢাকা পোস্ট।

প্রায় ৪০ বছর ধরে পেশাদার আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন অ্যাডভোকেট মো. জয়নাল আবেদীন সিকদার। বাবা হিসেবে তার স্বপ্ন ছিল সন্তানরা আইন বিষয়ে পড়ুন। সে অনুযায়ী ছয় সন্তানই আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, কেউ হওয়ার অপেক্ষায় আছেন।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে একজন সন্তানকে বড় করে তোলেন বাবা-মা, চিরাচরিত এই সত্যবচন জানিয়ে জয়নাল আবেদীন সিকদার বলেন, সন্তানকে হাঁটতে শেখানো থেকে শুরু করে মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়া, হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাওয়া― এসব তাজা স্মৃতি কোনো মা-বাবার মনে ফিকে হয় না মৃত্যুর দিন পর্যন্তও। বাবার চোখের সামনেই যদি অকালে প্রাণ হারায় প্রিয় ছেলে, সে বাবার বাকি জীবনটা জীবন্ত লাশের মতো।

তিনি জানান, তার বড় ছেলে পুলিশ সার্জেন্ট থাকাকালীন ২০১২ সালে গাড়িচাপায় নিহত হন। তার আগেই এলএলবি সম্পন্ন করার পাশাপাশি বার কাউন্সিলের সনদ অর্জন করেছিলেন।

২০১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় হঠাৎ একটি ফোন এল তার বড় সন্তান পুলিশ সার্জেন্ট রিয়াজ উদ্দীন ঢাকার পান্থপথে দায়িত্ব পালনকালে গাড়িচাপায় গুরুতর আহত হয়েছেন। মেধাবী এই পুলিশ কর্মকর্তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চার ঘণ্টা পরই ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

এদিকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে তার আরেক ভালোবাসার মানুষ তার স্ত্রীও জানতেন না তার স্বামীকে এভাবে দেখতে হবে। তাদের বিয়ে হয়েছিল মৃত্যুর মাত্র ১০ মাস আগে।

রিয়াজ উদ্দীন সার্জেন্ট ব্যাচ-২০০৭-এর প্রথম স্থান অধিকারী ছিলেন। ক্রীড়াঙ্গনে ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তার সরব পদচারণ ছিল। কোর্স সমাপ্তিতে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে বের হওয়া ম্যাগাজিন- ‘অঙ্গীকারে’র সম্পাদনাও করেছিলেন রিয়াজ উদ্দীন।

স্কয়ার হাসপাতালে ৮ দিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই বিসিএসের ফলাফল বেরোল। সেখানে পুলিশ ক্যাডারে নাম আসে রিয়াজ উদ্দীনের। দুঃখের বোঝাটা আরও পাহাড়সম হয় জয়নাল আবেদীনের।

অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন সিকদার বলেন, পুলিশ সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করে। তারাও কারও সন্তান, কারও বাবা, কারও স্বামী বা স্ত্রী। তাদের খুশিতে যেমন আনন্দিত হওয়ার মানুষ আছে, তেমনি তাদের জন্য কান্না করারও কেউ আছে।

বড় ছেলে রিয়াজ উদ্দিন মৃত্যুর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে এলএলবি সম্পন্ন করার পাশাপাশি বার কাউন্সিলের সনদ অর্জন করেছিলেন।

মেজ ছেলে অ্যাডভোকেট মো. মিরাজ উদ্দিন সিকদার ঢাকা জজ কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ঢাকার সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেছেন। তার কাছে তার বাবার সততা ও গরিব মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়ার গুণটিই বেশি অনুকরণীয়।

বড় মেয়ে ফজিলাতুন্নেছা স্নাতকোত্তর পাস করার পাশাপাশি ঢাকার সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেছেন। তিনি এই মুহূর্তে কোনো প্র্যাকটিস করছেন না। তবে তার কারছে তার বাবার ধৈর্য ও সহনশীলতার গুণ তার জন্য অনুকরণীয়।

ফজিলাতুন্নেছার স্বামী হাফিজুর রহমান কাঞ্চনও এলএলবি সম্পন্ন করে আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন। তিনি এখন হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করছেন।

ছোট মেয়ে নাহিদ সুলতানা স্নাতকোত্তর পাস করার পাশাপাশি বরিশাল ল কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেছেন। বাবার সঙ্গে ঝালকাঠি জজ কোর্টে সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় দুই বছর। কাজের প্রতি গুরুত্ব, প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং দায়িত্ববোধের মতো গুণগুলো বাবার কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন তিনি।

নাহিদ সুলতানার স্বামী রিপন হোসেনও এলএলবি সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন।

পঞ্চম ছেলে রমজানুল মোর্শেদ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এমএসএস সম্পন্ন করার পর বরিশাল ল কলেজে এলএলবি পড়ছেন। বাবার সরলতাই তার কাছে বেশি প্রিয়।

ছোট সন্তান রিয়াজুস সালেহীনও বরিশাল বিএম কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর বরিশাল ল কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেছেন। জীবনে হিসাব করে চলা, সময়ের কাজটি সময়ে করা, বসে না থেকে নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখা ও নিরহংকার থাকার গুণগুলো সরাসরি বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন বলে জানান রিয়াজুস সালেহীন।

বাবা সম্পর্কে ছোট ছেলে রিয়াজুস সালেহীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবার ভালোবাসার কাছে আমরা সব ভাইবোন ঋণী। আমি তার মতো আদর্শবান মানুষ হতে চাই। তার দেখানো পথে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই।

সব সন্তানকে আইন বিষয়ে পড়ানোর কারণ জানতে চাইলে জয়নাল আবেদীন সিকদার জানান, এটি স্বাধীন পেশা। গরিব-অসহায় মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়া যায়। নিষ্ঠার সঙ্গে সৎ পথে অর্থ উপার্জন করা যায়। আমার চাওয়া ছিল সব সন্তান যদি আইন পাস করে, তারাই অসহায়দের সহায় হতে পারবে।

এনএ