১২ হাজার চাষির আম নিচ্ছে প্রাণ
অ্যাগ্রোভিত্তিক পণ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ২০০১ সালে নাটোর শহরতলির একডালায় স্থাপিত হয় প্রাণ অ্যাগ্রো-ফ্যাক্টরি। এই কারখানার কারণে যেমন আমচাষিদের জীবনমান উন্নয়ন, কয়েক হাজার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান ও তাদের আর্থিক উন্নতিসহ পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা, তেমনি পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে রাখছে বিরাট ভূমিকা।
বছরজুড়ে প্রাণ অ্যাগ্রো কারখানায় প্রায় সাত হাজার লোক নিয়োজিত থাকেন বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকাজে। এ ছাড়া আম ও টমেটোর মৌসুমে আরও প্রায় তিন হাজার লোকের বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কর্মরত এসব শ্রমিকের অধিকাংশই নারী। ফলে সামাজিকভাবে তারা যেমন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন, পরিবারেও আসছে সচ্ছলতা। নারী কর্মীদের অধিকাংশই নাটোর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাস করেন।
একটা সময় ছিল যখন কয়েক হাজার নারী-পুরুষ কর্মসংস্থানের খোঁজে পাড়ি জমিয়েছেন ব্যস্ত নগরী ঢাকায়। অনেকেই হয়েছেন স্বাবলম্বী, অনেকই হারিয়েছেন সহায়-সম্বল। কেউবা বসেছেন পথে। কিন্তু নাটোরে প্রাণ প্রতিষ্ঠার পর তার চিত্র পুরোটাই পাল্টে গেছে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রাণ অ্যাগ্রো-ফ্যাক্টরিকে ঘিরে নাটোরের একডালায় রাস্তার দুপাশে গড়ে উঠেছে বিশাল আমের আড়ত। সেখানে আম বাছাই করে পাঠানো হচ্ছে কারখানায়। চলতি আমের মৌসুমে হাজার হাজার নারী-পুরুষ কাজ করছেন। প্রতিদিন ৫৫০ টন আমের পাল্প করার সক্ষমতা নিয়ে গড়ে উঠেছে কারখানাটি।
চলতি বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ অঞ্চলে ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এ ছাড়া নাটোর, পাবনা ও এর পার্শ্ববর্তী জেলায়ও এ বছর আমের ভালো ফলন হয়েছে। এসব আমের মধ্যে রয়েছে গুটি আম, হিমসাগর, ল্যাংড়া, আশ্বিনাসহ বিভিন্ন প্রজাতের। প্রাণ সারা বছর ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংক, ম্যাংগো বার, আচার, চাটনি প্রভৃতি আমজাত খাদ্যপণ্য তৈরির জন্য মৌসুমে চাষিদের কাছ থেকে আম সংগ্রহ করে পাল্প তৈরি করে।
কারখানা সূত্রে জানা গেছে, আমের জন্য খ্যাত জেলাগুলোয় প্রাণের প্রায় ১২ হাজার চুত্তিভিত্তিক চাষি রয়েছেন, যাদের কাছ থেকে আম সংগ্রহ করা হয়। প্রাণের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আম চাষ করে উত্তরাঞ্চলের অনেক কৃষক সৌভাগ্যের মুখ দেখছেন। প্রাণ আমচাষিদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে আম সংগ্রহ করে থাকে। ফলে আমচাষিদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকায় তারা আরও চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন এবং দিনে দিনে লাভবান হচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
প্রাণ আমচাষিদের কাছ থেকে মূলত গুটি ও আশ্বিনা জাতের আম কিনে থাকে। চলতি বছর প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন পাকা আম কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে প্রাণ। সে অনুযায়ী আম সংগ্রহ করা শুরু হয়েছে। গোদাগাড়ী কারখানায় প্রতি কেজি ১৪ থেকে ২০ টাকা দরে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নাটোর, নওগাঁ, পাবনাসহ পার্শ্ববর্তী জেলার আম আম কেনা হচ্ছে।
গত ১ জুন থেকে গুটি আম সংগ্রহ ও পাল্পিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যা চলবে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এরপর আশ্বিনা আম থেকে পাল্প সংগ্রহ শুরু হবে। কারখানায় আম সংগ্রহ চলবে আগস্ট পর্যন্ত আমের সরবরাহ থাকা সাপেক্ষে। পাল্পের জন্য মূলত গুটি ও আশ্বিনা জাতের আমই সবচেয়ে ভালো। সংগৃহীত আম থেকে পাল্প উৎপাদন করে অ্যাসেপটিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়।
আম পাল্পিংয়ের প্রক্রিয়া
প্রাণ অ্যাগ্রো লিমিটেড কারখানায় সংগৃহীত আম থেকে কয়েকটি ধাপে পাল্প তৈরি হয়। ফ্যাক্টরিতে আম প্রবেশের সময় কোয়ালিটি কন্ট্রোলার দ্বারা আম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তা গ্রহণ করা হয়। প্রথমে আমগুলো পাকা কি না, পোকা-রোগমুক্ত ও পচা কি না, তা পরীক্ষা করা হয়। এরপর ল্যাবে পাঠানো হয় ফরমালিন, ব্রিক্স, পি-এইচসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষার জন্য। ল্যাব টেস্টে উত্তীর্ণ হলেই কেবল তার আম ফ্যাক্টরিতে প্রক্রিয়াকরণের জন্য নেওয়া হয়।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমগুলো প্রথমে কনভেইনার বেল্টে ঢালার পর কয়েকটি ধাপে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে আমকে পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। এরপর আটোমেটিক মেশিনে পাল্প ও আঁটি আলাদা করা হয়। এরপর রিফাইনারি মেশিনে পাল্প পরিশোধন এবং স্টেরালাইজড করে পাল্পকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত করা হয়। এরপর হাতের স্পর্শ ছাড়াই অ্যাসেপটিক প্রযুক্তিতে পাল্প সংরক্ষণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে কমপক্ষে দুই বছরের জন্য পাল্প নিরাপদ, তাজা ও স্বাদ অক্ষুণ্ন থাকে।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও মানুষ স্বাস্থ্যসচেতন হওয়ায় ফলের জুস বা ড্রিংকসের বড় সম্ভাবনা আছে। এ ক্ষেত্রে ভোক্তাদের মধ্যে অস্বচ্ছতা দূর করা প্রয়োজন। এ ছাড়া আমের পাল্প তৈরির জন্য ভালো গুটি আমের চাষ বৃদ্ধি করা দরকার। দেশে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ আরও বাড়াতে হবে। এতে একদিকে যেমন কৃষক লাভবান হবেন, অন্যদিকে দেশ ও দেশের বাইরে বাংলাদেশি ফ্রুট ড্রিংক ও জুসের বাজার বাড়বে।
তারা জানান, প্রাণ গ্রুপের লক্ষ্য, আগামী দিনে ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংকের পাশাপাশি সরাসরি ম্যাংগো পাল্প বিদেশে রফতানি করা। এ লক্ষ্যে আমচাষিদের নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এতে তাদের জীবনমান উন্নয়ন, পণ্য রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দেশের অর্থনীতি বিকাশে বড় ভূমিকা রাখবে।
জানা যায়, দেশের মোট উৎপাদিত আমের প্রায় অর্ধেকের বেশি আসে নাটোর, নওগাঁ, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। এসব এলাকায় যেমন নানা উন্নত জাতের আমের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে, তেমনি আগে থেকে প্রচুর গুটি আমগাছ রয়েছে, যা মোট উৎপাদনের প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। কিন্তু প্রতিবছর এ বড় অংশের আম নষ্ট হচ্ছে। আমের যে সার্বিক অপচয়, এর মধ্যে গুটি আমের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন
দেশের উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি কৃষিজাত পণ্য উৎপাদিত হয়। সে জন্য প্রাণ কোম্পানি নাটোরে অ্যাগ্রো ফ্যাক্টরি স্থাপন করেছে। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করছে প্রাণ অ্যাগ্রো ফ্যাক্টরি। সারাদেশে প্রায় আট হাজার মানুষ প্রাণ কোম্পানিতে কাজ করেন। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ ১২৫ বিঘা আয়তনের প্রাণ কারখানায় জ্যাম-জেলি, মসলা, সস, আচার, চাটনি, নুডলস, সরিষার তেল, চাল, বাদাম, ডাল, দুধ, লাচ্চাসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের জন্য এখানে প্রোডাকশন লাইন চালু রয়েছে। এ ছাড়া আম ও টমেটো মৌসুমে সেগুলো সংগ্রহ করে এ ফ্যাক্টরিতে পাল্প তৈরি করা হয়।
শ্রমিক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, আমি দীর্ঘদিন থেকে এই কারখানার সঙ্গে জড়িত আছি। এখানে কাজ করে বর্তমানে খুব ভালো আছি। আগে আমার সংসারে অভাব লেগে থাকত। এখন খুব ভালোভাবে চলছি। আমি চাই প্রাণ কোম্পানি আরও এগিয়ে যাক। এতে আমাদের মতো গরিব-অসহায় মানুষের বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন হবে।
আমচাষি রনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ২০টা বাগান রয়েছে। আমি প্রাণ কোম্পানিতে দীর্ঘদিন থেকে আম দিয়ে থাকি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, গত বছর দাম বেশি পেয়েছি। কিন্তু এবার তুলনামূলক দাম অনেক কম। এতে আমার লোকসান গুনতে হচ্ছে। প্রাণ কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যদি আমাদের দিকে একটু নজর দিতেন, তাহলে আমরা ভালোভাবে চলতে পারতাম।
কাঁচামাল সরবরাহ কমিটির সভাপতি মো. আফছার আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ১৯৯৮ সাল থেকে প্রাণ কোম্পানির সঙ্গে জড়িত আছি। প্রাণ কোম্পানি যখন জমি কিনতে প্রথম এখানে আসে, তখন আমাদের ধারণা হয় যে এখানে একটা শিল্পপ্রতিষ্ঠান হলে কর্মসংস্থান বাড়বে। এই অঞ্চলের বেকারত্ব দূর হবে। সেদিক বিবেচনা করে আমরা স্বল্প মূল্যে জমি প্রাণ কোম্পানিকে দিই।
তিনি আরও বলেন, ২০০১ সাল থেকেই আমরা সব ধরনের কৃষিপণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করার সুযোগ পাচ্ছি। এতে আমরা এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছি। এখানে এলাকার অনেক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা।
তেবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. খাজামুদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অসহায় ও বেকার যেসব লোকজন আছেন, তারা প্রাণের কারখানায় চাকরি পেয়েছেন। আমার ওয়ার্ডের প্রায় এক হাজার মানুষ এখানে কাজ করছেন। সবাই এখন ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারছেন।
নাটোর প্রাণ অ্যাগ্রো লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার হযরত আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন এলাকায় প্রাণের প্রায় ১২ হাজার চুত্তিভিত্তিক চাষি রয়েছেন, যাদের কাছ থেকে প্রতিদিন আম সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রাণের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আম চাষ করে উত্তরাঞ্চলের অনেক কৃষক সৌভাগ্যের মুখ দেখছেন। প্রাণ আমচাষিদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে আম সংগ্রহ করে। ফলে চাষিদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকায় তারা আরও চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন এবং দিন দিন লাভবান হচ্ছেন।
এনএ