লক্ষ্মণভোগ আমকে ডায়াবেটিস আম বলেও ডাকেন

ভরা মৌসুমে সবাই যখন আমের স্বাদ নিচ্ছেন, তখন ডায়াবেটিস রোগীরা আম খাবেন কি খাবেন না, এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। আমে আছে সুগার, এ জন্য এড়িয়ে চলছেন। তাই বলে কি আম খাওয়া বাদ? তাই বিকল্প খুঁজে বের করেছেন ডায়াবেটিস রোগীরা। সাম্প্রতিক সময়ে ডায়াবেটিস রোগীরা ঝুঁকছেন বারি-২ বা লক্ষ্মণভোগ আমের দিকে।

অন্যান্য আমের তুলনায় কম মিষ্টি বা সুগারের পরিমাণ কম, দেখতে ও গন্ধে খুব ভালো হওয়ায় স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিদের কাছে প্রথম পছন্দ এখন লক্ষ্মণভোগ আম।

চিকিৎসকরা বলছেন, আমের সুগার প্রাকৃতিক হলেও বেশি খাওয়া উচিত নয়। এটি রক্তের সুগার লেভেলের জন্য ক্ষতিকর। গ্লুকোজ লেভেলেও প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, বাজারে গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি আমের মিষ্টতা বেশি থাকায় সাধারণত ডায়াবেটিসের রোগীরা এসব আম খাওয়া থেকে বঞ্চিত হন।

অন্যদিকে লক্ষ্মণভোগ আমে রং, আকৃতি, গুণ ও স্বাদ তুলনামূলক ভালো এবং মিষ্টতা কম। তাই অনেকেই এখন লক্ষ্মণভোগ আমকে ডায়াবেটিস আম বলেও ডাকেন। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্থানীয়ভাবে লক্ষণভোগ আম লখনা নামেই বেশি পরিচিত।

আম গবেষকদের মতে, লক্ষ্মণভোগ আম হচ্ছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে আসা আমের একটি জাত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সর্বপ্রথম লক্ষ্মণভোগকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকারক জাত হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তাই মালদায় লক্ষ্মণভোগকে সেখানকার শ্রেষ্ঠ আমের জাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এমনকি ভারতের জাতীয় আম উৎসবে সেরা আম হিসেবেও স্বীকৃতি পায় লক্ষ্মণভোগ। মালদার পার্শ্ববর্তী এলাকা ও বাংলাদেশের আমের রাজধানীখ্যাত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জেও চাষকৃত আমের কয়েকটি প্রধান জাতের মধ্যে রয়েছে লক্ষ্মণভোগ।

জেলার সদর, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলার কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে লক্ষ্মণভোগ আমের গাছ রয়েছে। তবে কী পরিমাণ জমিতে লক্ষ্মণভোগের চাষাবাদ হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই কৃষি বিভাগের কাছে।

ফার্মেসি দোকানদার আব্দুল মান্নান (৪৫) জানান, প্রায় ৭০ ভাগ মানুষই সুগারের আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করে। ফার্মেসি থাকার সুবাদে জানি, কত মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। আমি নিজেও চিনিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। এমনকি কোনো আমই খাই না। তবে মিষ্টি কম হওয়ার কারণে মাঝেমধ্যে লক্ষ্মণভোগ আম খাই।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার প্রফেসরপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১০ থেকে ১২ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছি। নিজের বাগানের প্রচুর আম বাড়িতে নষ্ট হয়। খেতে পারি না, ডায়াবেটিসের ভয়ে। তবে এক ভাতিজার পরামর্শে গত বছর থেকে লক্ষ্মণভোগ আম দু-একটা করে খাচ্ছি। আমটা একটু মিষ্টি কম হলেও এর সুঘ্রাণ আছে অন্য সব আমের থেকে বেশি। পাকলে টকটকে হলুদ রং ধারন করে, যা সব মানুষকেই আকর্ষণ করে।

দেশের সবচেয়ে বড় আমবাজার কানসাটের আড়তদার ও মেসার্স ডিয়ার ফল ভান্ডারের মালিক দোস্ত মোহাম্মদ জানান, বর্তমানে বাজারে লক্ষ্মণভোগের দাম চলছে মণে (৪০ কেজিতে) ৭০০-৮০০ টাকা। বাজারে চাহিদা থাকলেও এখন ক্ষীরশাপাত আমের ভরা মৌসুম থাকার কারণে দাম অনেক কম রয়েছে। আগামী সপ্তাহে লক্ষ্মণভোগ আমের দাম কিছুটা বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম রাব্বানী ঢাকা পোস্টকে জানান, লক্ষ্মণভোগ আমে সুগার নেই বা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অসুবিধার কারণ নাই, বিষয়টি এমন নয়। যেকোনো সুগারই অত্যন্ত হুমকির। তবে লক্ষ্মণভোগ আম মিষ্টি কম হওয়ায় তা অন্যান্য আমের তুলনায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সুবিধাজনক। তবে খাওয়ার পরিমাণ অব্যশই পরিমিত হতে হবে।

আম গবেষকদের মতে, লক্ষ্মণভোগ আমের আঁশ খুবই কম। এর রং ও গন্ধ অসাধারণ। খোসা কিছুটা মোটা হলেও আঁটি পাতলা। আম দ্রুত পচনশীল ফল হলেও অন্যান্য জাতের তুলনায় লক্ষ্মণভোগ অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। এমনকি লক্ষ্মণভোগ আম পাকার পরও ৮ থেকে ১০ দিন ভালো থাকে। আমটি ওজনে ১৫০-৮০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। হালকা মিষ্টি ও অন্যান্য আকর্ষণীয় গুণাবলির কারণে বিদেশিদের পছন্দের শীর্ষে লক্ষ্মণভোগ। এই আমের প্রায় ৭৫ ভাগ অংশই ভক্ষণযোগ্য।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব আম গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্যান্য আমের তুলনায় ৫-১০ শতাংশ কম মিষ্টি ডায়াবেটিস রোগীদের খুব পছন্দের জাত লক্ষ্মণভোগ। অনেক গুণাবলির কারণেই লক্ষ্মণভোগকে রফতানিযোগ্য ফল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, নানা সুবিধার কারণে এই জাতের আম চাষাবাদের জন্যও অনেক উপযোগী। বিরূপ আবহাওয়ায়ও ভালো ফলন দেয় লক্ষ্মণভোগ। 

এনএ