একদিকে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীতে তীব্র স্রোত, অন্যদিকে মেঘনায় জেগে ওঠা চরের কারণে চরম হুমকির মুখে পড়েছে চাঁদপুর শহররক্ষা বাঁধ। ধীরে ধীরে চর বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি বাঁধ এলাকায় মেঘনা নদীর গভীরতা বাড়ছে। বাঁধ এলাকায় মেঘনা নদীর গভীরতা সর্বোচ্চ ৫৭ মিটার পর্যন্ত রয়েছে। দ্রুত মেঘনার বুকে নতুন করে জেগে ওঠা চর পরিকল্পিতভাবে খনন করার পাশাপাশি শহররক্ষা বাঁধ স্থায়ী সংস্কারে ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছে শহরবাসী।

এদিকে বিগত কয়েক বছর ধরে তীব্র ঘূর্ণিস্রোতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাঁদপুর শহররক্ষা বাঁধ। স্রোতের কারণে তীরে থাকা শহররক্ষা বাঁধের পাথর ও ব্লক নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যদিও ভাঙন কবলিত স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তীব্র স্রোতের কারণে স্থায়ী বাঁধ না হওয়ার কারণে ভাঙনের স্থানে আবারও ভাঙন দেখা দেয়। এতে শত শত স্থাপনা ভাঙন ঝুঁকিতে থাকে।

চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানা যায়, চাঁদপুর শহর ভাঙনরোধে ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৪০ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন বাজার এলাকায় ১ হাজার ৭৩০ মিটার এলাকায় শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে আরও প্রায় ২৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে পুরান বাজার এলাকার ১ হাজার ৬৩০ মিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়।

চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য মতে, গত ২০১৯ ও ২০২০ সালে শহরের পুরানবাজার হরিসভা এলাকায় একাধিক বার ভাঙনের কবলে পড়েছে শহররক্ষা বাঁধটি। এতে করে ৬৭ মিটার এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। বাঁধ রক্ষায় অস্থায়ীভাবে কাজ হয়েছে কয়েক কোটি টাকার। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫৮ মিটার সংস্কার কাজে ব্যয় হয়েছে ২৮ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৮৫ মিটার সংস্কার কাজে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং ২০১৯-২০ সালে বাঁধ রক্ষায় ৩২৪ মিটার সংস্কার কাজে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ১১ লাখ টাকা।

স্থানীয় বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন বলেন, প্রতিবছর ভাঙন দেখা দিলেই কাজ হয়। এছাড়া অন্য কোনো সময় কাজ হয় না। ভাঙনের স্থানে যেটুকু কাজ হয়, তাও আবার অস্থায়ী। এই কারণে সব সময় হুমকিতে থাকে শহররক্ষা বাঁধ। স্থায়ী বাঁধ না হওয়ার কারণে পুরানবাজারের অনেক মানুষ নিজের শেষ সম্বল ঘর হারিয়েছেন। বর্তমানের যারা আছেন, তারাও আতঙ্কে দিন পার করছেন।

জাকির হোসেন মৃধা নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, মেঘনার চর, যেটা আমরা মিনি কক্সবাজার হিসেবে চিনি এটি প্রায় আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার হবে। শীতের সময় চর জাগে। আর বর্ষায় তলিয়ে যায়। চর থাকাকালীন মানুষ সেখানে ঘুরতে যায়। কিন্তু এই চর শহররক্ষা বাঁধের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষার সময় উজান থেকে নেমে আসা পানির স্রোতে চরের সঙ্গে ঘূর্ণনের সৃষ্টি হয়। এতে বিপরীত স্রোতের কারণে শহররক্ষা বাঁধে চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে মেঘনার চরটি খনন করা জরুরি।

চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম বলেন, পুরানবাজর এলাকা ব্যবসায়ীক এলাকা। শহর রক্ষাবাঁধের কিছু হলে পুরানবাজারের অন্তত ৪০ থেকে ৫০টি মিল-কারখানাসহ প্রায় আড়াইশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদী গর্ভে চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। এত অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে। এ জন্য এখানে স্থায়ীবাঁধ নির্মাণে সরকারের পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি।

চাঁদপুর সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, শহররক্ষা বাঁধ স্থায়ীভাবে সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি। বর্ষায় পানি প্রবাহিত হয়, তখন চরের কারণে ওই অঞ্চল দিয়ে পানি অধিক চাপে প্রবাহিত হয়। এতে করে পানির চাপ বৃদ্ধি পেয়ে পাড়ে ঘূর্ণনের সৃষ্টি হয়ে ভাঙন দেখা দেয়। তাই শহররক্ষা বাঁধ টিকিয়ে রাখতে মেঘনায় জেগে ওঠা চর পরিকল্পিতভাবে খনন করা দরকার।

এ বিষয়ে চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রেফাত জামিল বলেন, ভাঙনের স্থানে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। চাঁদপুর শহররক্ষা বাঁধ টিকিয়ে রাখতে হলে জরুরি ভিত্তিতে নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা চর খনন করে নদীর গতিপথ ঠিক করতে হবে। একই সঙ্গে শহররক্ষা বাঁধের স্থায়ী সংস্কার প্রয়োজন। তা না হলে শহররক্ষা বাঁধ বিলীন হয়ে চাঁদপুর শহর তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

শরীফুল ইসলাম/আরএআর