৪০ বছরে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ি নাই
‘লকডাউনের কথা হুইন্যা গত দুই দিন বাড়ি থেইক্যা বাইর হই নাই। ঘরে যা আছিলো তাই খাইছি। আজকা আর কোনো ব্যবস্থা নাই। হেলেইগ্যা মেয়ের কাছ থেইকা ১০ টেহা লইয়া নদী পাড় হইয়া শহরে আইছি। সাড়ে ৯টা থেইকা এইহানে বইয়া রইছি, কামাই হইছে মাত্র ১০ টেহা। এই টেহা তো নৌকা ভাড়াই লাগবো। বাড়িত কি লইয়া যামু?’
চোখে-মুখে হতাশা নিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন পরেশ (৬০) নামে এক মুচি। তিনি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর ঈশ্বরদিয়া এলাকার বাসিন্দা। ৪০ বছর ধরে নগরীর গাঙ্গিনারপাড় মোড়ের ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের নিচে রাস্তার পাশে বসে জুতা সেলাই ও পলিশের কাজ করেন পরেশ।
বিজ্ঞাপন
এখান থেকে যে আয় হয় তা দিয়েই চলে তার সংসার। এই কাজ করেই তিনি দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেকে বড় করেছেন। তারা দুইজন চটপটির দোকান চালান পার্কে। তবে দীর্ঘদিন ধরে পার্ক বন্ধ থাকায় তাদের রোজগার নেই। তাই গোটা পরিবার এখন নির্ভর পরেশের ওপর।
শনিবার (০৩ জুলাই) বিকেল ৩টার দিকে কথা হয় তার সঙ্গে। আলাপকালে পরেশ বলেন, ‘সারাদিন কাম কইরা যা পাই তাই দিয়া বাজার-সদাই করি। করোনা আইয়া আয় কমে গেছে। আগের মত কাম নাই। তার ওপর আবার লকডাউন। সহালে না খাইয়াই আইছি। হারাডা দিন পানি খাইয়াই রইছি। ভাবছি কিছু কাম কইরা কয়ডা টেহা লইয়া যাই। কিন্তু মানুষই তো নাই, ৫ ঘণ্টা বইয়া থাইক্কা ১০ টেহা কামাই অইছে। ৪০ বছরে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ি নাই গো বাবা। এইরুম অইলে কয়দিন বাঁচোন যাইবো জানি না।’
বিজ্ঞাপন
লকডাউনের কঠিন বাস্তবতার শিকার শুধু পরেশই নন, এমন অবস্থা সব দিনমজুরেরই। সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধে দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করেও কাজ পাচ্ছেন না অনেকে। ফলে পরিবারের জন্য খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
সকালে নগরীর চরপাড়া মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় কয়েকজন শ্রমিককে। দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, কাজের অপেক্ষায় প্রতিদিনের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে তিনদিন ধরে কেউ তাদের কাজে নেওয়ার জন্য আসেনি। তাই তারা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কষ্টের মধ্যে পড়েছেন। সারাদিন কাজ করে তাদের ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় দিয়েই চলতো সংসার। এখন লকডাউনে বন্ধ হয়ে গেছে সেই রোজগার।
ছয় সদস্যের সংসার ইউনুস আলীর। সারাদিনে শ্রমিকের কাজ করে যা আয় হয় তাই নিয়ে যান বাড়িতে, করেন বাজার। আলাপকালে ইউনুস আলীর বলেন, ‘লকডাউন দিছে বালা কতা, আমরা কী করতাম এইডা তারা কইয়া দেক। এই সাতদিন যদি কাম না পাই তাইলে তো মরা ছাড়া গতি নাই। কিছু সাহায্য সহযোগিতা করলে তো অন্তত খাইয়া বাঁচতে পারতাম।’
সকালে সদরের দাপুনিয়া থেকে নগরীতে এসেছেন রিকশাচালক আব্দুর রহিম। দুপুর ৩টার দিকে গাঙ্গিনারপাড় মোড়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১০টা থেইক্যা রিকশা চালাইতাছি, মাত্র ২০০ টেহা কামাই অইছে। ৬টার দিকে মালিককে ২৫০ টাকাসহ রিকশা জমা দিতে অইবো। কয় টেহা বাড়িত নিয়া যাইতে পারমু বুঝেন তাইলে।’
এ ব্যাপারে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, করোনা সংক্রমণের হার কমানোর জন্য সরকার বিধিনিষেধ দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের চলতে কষ্ট হচ্ছে। দেশের বৃহৎ স্বার্থে আমাদের সবাইকে তা মেনে নিতে হবে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী অসহায় মানুষকে সহায়তা করা হবে। আমরা আশা করছি কেউ না খেয়ে থাকবে না।
উবায়দুল হক/আরএআর