সিলেট নগরের চৌহাট্টায় অবস্থিত শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের সামনে ২৫ জন জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ঘড়ির কাটায় তখন দুপুর ১২টা। তারা সবাই হাসপাতালটির প্যাথলজি বিভাগের সামনে দাঁড়ানো। সবাই এসেছেন মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি না, পরীক্ষার করানোর জন্য।

প্যাথলজি বিভাগের সামনেই একটি চেয়ারে বসিয়ে তাদের পরীক্ষা করানো হচ্ছে। ভেতর থেকে একজন নাম ধরে ডাকছেন আর বাইরে দাঁড়ানো সেই ব্যক্তি ভেতরে প্রবেশ করছেন।

সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগই জ্বর, সর্দি, কাঁশিতে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন। পরে বাধ্য হয়েই তারা করোনা পরীক্ষা করার জন্য হাসপাতালটিতে এসেছেন।

তাদের মধ্যে একজন দেলোয়ার হোসেন। কয়েকদিন ধরে তিনি জ্বর অনুভব করছিলেন। সিলেট নগরের উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করাতে গেলে সেখানে তাকে ভর্তি হতে বলা হয়। তবে সেখানে তিনি ভর্তি না হয়ে সোমবার (৫ জুলাই) শামসুদ্দিন হাসপাতালে এসেছেন নমুনা দেওয়ার জন্য।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার শরীরে ভেতরে ভেতের জ্বর অনুভব করছি। এছাড়া আর তেমন কোনো সমস্যা নেই। তবুও মনের সন্দেহ দূর করার জন্য একটি প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তবে তারা আমাকে সেখানে ভর্তি হতে বলে। ভর্তি না হলে তারা করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা নিতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। তাই আমি সেখানে ভর্তি না হয়ে এই হাসপাতালে এসেছি।

বৃহস্পতিবার (৫ জুলাই) সকাল থেকেই সিলেটের একমাত্র করোনা ডেডিকেটেড শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। দুপুর ১২টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ২৫ জন মানুষ জটলা বেঁধে রয়েছেন। তারা করোনা পরীক্ষা করাতে এলেও তাদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়টি ছিল না। সেখানে উপস্থিত কয়েকজনের মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরা ছিল। অন্যদের মুখে শুধু মাস্ক পড়া ছিল।

প্যাথলজির সামনেই রুমানা বেগম নামের এক নারী বসে ছিলেন। দূর থেকে দেখলেই তাকে মনে হচ্ছিল খুব বেশি অসুস্থ। আলাপকালে তিনি বলেন, কয়েকদিন থেকেই তার জ্বর সর্দি কাশি। শ্বাসকষ্টও রয়েছে। ঠিকমত কথা বলতে পারি না। তাই আজকে এখানে পরীক্ষা করাতে এসেছি।

দুপুর তখন ১২টা ০২ মিনিট। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে দু’জন মানুষ এসে নেমেছেন হাসপাতালটি গেটের সামনে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোগীর স্বজন বলেন, কিছুদিন ধরে শরীরে প্রচণ্ড জ্বর। যার কারণে ছোট ভাইটিকে এখানে ভর্তি করাতে এসেছি।

তবে জানা গেছে, ওই রোগী সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থী। করোনা সংক্রমিত হতে পেরে আশঙ্কায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

তার ঠিক আট মিনিট পর ১২ টা ১০ মিনিটে আরেক রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসেন স্বজনরা। তার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল এবং তিনি করোনা পজিটিভ ছিলেন। সেই সময় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ওই রোগীর শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনা করে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) প্রয়োজন। তবে আইসিইউ বেড রোগীতে পরিপূর্ণ থাকায় তাকে ওয়ার্ডে রেখেই অক্সিজেন সরবরাহ করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

তার ঠিক আধাঘণ্টা পর ১২টা ৪০ মিনিটে আরেকজন করোনা পজিটিভ রোগী সেখানে ভর্তি হন। তার শারীরিক অবস্থাও অনেকটা শঙ্কটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাকে হাসপাতালের ওয়ার্ডের রেখে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে।

হাসপাতালে ভর্তি একজন রোগীর স্বজন শাখাওয়াত হোসেন বলেন, পাঁচ দিন ধরে আমাদের রোগীকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। শুরুর দিকে তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বর্তমানে তার অবস্থা ভালো। চিকিৎসকরা খুব গুরুত্ব দিয়ে রোগীদের সেবা করছেন।

সোমবার (৫ জুলাই) দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত এই তিনজন রোগী শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি হন। আর এই তিনজন ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতালটিতে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮ জন।

দুপুর ১২টা ৫৮ মিনিটে সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে মাকে নিয়ে হাসপাতালটিতে এসেছিলেন দিপন খান। তার মায়ের শুধু শ্বাসকষ্ট ছিল। তবে হাসপাতালে করোনা সংক্রমিত অথবা আশঙ্কা আছে এমন রোগী ছাড়া ভর্তি না করার কারণে চিকিৎসকরা তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বলেছেন।

সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালটিতে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ১০০ শয্যা রয়েছে, তার মধ্যে ৯৮টিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন। আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১৬টি, তার মধ্যে দুটি আইসিইউ বরাদ্দ রয়েছে ডায়ালাইসিস রোগীদের জন্য। বর্তমানে ১৫টি আইসিইউতে রোগী রয়েছেন।

সিলেট বিভাগে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা। অন্যান্য বিভাগের তুলনায় সিলেটে মৃত্যুহার ও সংক্রমণ অনেকটাই কম বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির চিকিৎসকরা।

সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্যান্য জায়গার তুলনায় আমাদের এখানে মৃত্যুহার ও সংক্রমণ অনেকাংশেই কম। কয়েকদিনে আমাদের এখানে মাত্র ১ জন রোগী মারা গেছেন। সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুহার কম।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে যে আইসিইউ রয়েছে সেটি পর্যাপ্ত না। তবে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ রয়েছে। আর এখন প্রতিটি রোগীর ১৫ থেকে ২০ লিটার অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। যেখানে আগে লাগত ৫ থেকে ১০ লিটার। আমাদের এখানে ১০ হাজার লিটার সেন্ট্রাল লাইন অক্সিজেন রয়েছে। এটি তিন হাজার লিটার কমে গেলেই আবারও সেটি পরিপূর্ণ করে দেওয়া হচ্ছে।

এমএসআর