অথচ হাসপাতালের করোনার নমুনা সংগ্রহের বুথ হাসপাতালের সামনে

বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের নিচতলার বহির্বিভাগে লোকজনের ভিড়। সামনে যেতেই দেখা গেল অনেকে আসছেন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে। নিচতলার ১০১ নং রুমের সামনে জটলা। করোনার নমুনা দিতে আসছে অর্ধশতাধিক মানুষ। অধিকাংশ এসেছে সকাল ৭টা থেকে ৮টার দিকে। কারণ, তারা জানে, সকাল ৮টা থেকে করোনার নমুনা নেওয়া হয়। কিন্তু বেলা ১১টা বাজলেও নমুনা কখন নেওয়া হবে, তা জানানো হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, অপেক্ষা করেন, নেওয়া হবে।

প্রাইভেট সেলস কোম্পানিতে চাকরিতে যোগদান করবেন জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার কামালপুর গ্রামের বাসিন্দা পবিত্র সরকার (২৫)। যোগদানের আগে তার কোভিড-১৯ এর ফলাফল লাগবে। তাই সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে এসেছেন হাসপাতালে। এসে জরুরি বিভাগ থেকে টিকিট কেটে সিরিয়াল পেয়েছেন ৩ নং। সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছেন।

তিনি জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নমুনা নেওয়া হচ্ছে না। তাই খোঁজ নিয়ে সকালে হাসপাতালে আসা। সকাল ৮টায় সিরিয়াল পেয়েছেন ৩ নং। কিন্তু এখন ১১টা বাজে। নমুনা কখন নেওয়া হবে, জানা নেই তার। তাই অপেক্ষা করছেন। করোনার রিপোর্ট না হলে চাকরিতে যোগদান করা যাবে না।

কথা হয় ভারতীয় নাগরিক সঞ্চয় ঠাকুরের সঙ্গে। তিনি কলকাতার বাসিন্দা। হাসপাতালে এসছেন করোনা পরীক্ষা করাতে। তিনি জানান, ব্যবসায়িক কাজে বগুড়ায় এসছিলেন লকডাউনের আগে। এখন ফিরতে হবে বাড়ি। তবে স্থলবন্দর দিয়ে বাড়ি ফিরতে জমা দিতে হবে করোনার রিপোর্ট। তাই আসা করোনার পরীক্ষার জন্য। তিনিও সকাল সাড়ে ৮টায় এসছেন। ১১টা বাজে, কখন পরীক্ষা হবে, জানেন না।

এদিকে বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখিয়ে রোগীরা বের হচ্ছেন। তাদের ঘিরে ধরছেন বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। ডাক্তার তার পরামর্শে কী ওষুধ লিখলেন, তার ছবি তুলতে ব্যস্ত তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, প্রতিদিন একটা নিদিষ্ট পরিমাণ রোগীর প্রেসক্রিপশন ছবি অফিসে জমা দিতে হয়। নইলে বসদের ঝাড়ি খেতে হয়। তাই রোগী ডাক্তারের রুম থেকে বেরোলেই তার কাছে যেতে হয়। গিয়ে প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেওয়া। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তারা এভাবে রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি সংগ্রহ করে থাকেন।

বেলা সোয়া ১১টা হাসপাতালের রুম নং ১১৭। সেখানে দেখা গেল কয়েকজন লোকের জটলা। এগিয়ে যেতেই জানা গেল। করোনার রিপোর্ট দেওয়া হয় এই রুম থেকে। কিন্তু জটলা কেন?

শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার বাবু, মালতীনগরের রিয়াদ, পুরান বগুড়া এলাকার আরজেনা বেগম জানান, গত ২৩ জুন করোনার নমুনা দিয়েছিলেন পরীক্ষার জন্য। গতকাল ম্যাসেজ পেয়ছেন রিপোর্ট এসেছে। এখানে এসে রিপোর্ট চাইলে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি তাকে বলছেন, রিপোর্ট আসেনি। তিনি জিজ্ঞাসা করছেন, ১৩ দিনেও রিপোর্ট আসল না কেন? আবার ম্যাসেজ পেয়েছেন রিপোর্ট সংগ্রহ করার।

রিয়াদও গত ২৮ জুন নমুনা দিয়েছেন। কিন্তু ১১ দিন হলো রিপোর্ট আসেনি। আরজেনা বেগম তার স্বামী আলম হোসেনের করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নিতে এসেছেন। আলম হোসেন ২৬ জুন করোনার নমুনা জমা দিয়েছিলেন। আজ সকালে ম্যাসেজ পেয়ে স্বামীর করোনার রিপোর্ট সংগ্রহ করতে এসেছেন তিনি। কিন্তু রিপোর্ট না পেয়ে ফিরে গেলেন বাড়িতে।

বেলা সাড়ে ১১টা একদল কোল ছুটছেন পিপিই পরা একজন মানুষের পেছনে। হাসপাতালের উত্তর পাশে একটি পরিত্যক্ত ঘরের সামনে লোকজনের নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। জানা গেল, করোনার নমুনা দিতে আসা মানুষদের সিরিয়ালি ডাকা হচ্ছে। এরপর নমুনা নেওয়ার পালা। বুথ কোথায়। খুঁজতে থাকা হলো, না বুথে নয়। একটি চেয়ার দেওয়া হয়েছে। সেখানে বসেই নমুনা প্রদানকারীর নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালের করোনার নমুনা সংগ্রহের বুথ হাসপাতালের সামনে। সেখানে বুথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। ইজিবাইকচালক শফিকুল অপেক্ষা করছেন যাত্রীর জন্য। তিনি জানালেন, বুথ আছে কিন্তু নমুনা পেছনের পুরোনো ঘরে নেওয়া হয়।

এবার নমুনা সংগ্রহের স্থানে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সেখানে সিরিয়ালে সবাই দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা নেই। সিরিয়ালে পুরুষরা চেয়ারে বসে নমুনা দিচ্ছেন। কিন্তু নারীদের সে সুযোগ নেই। দাঁড়িয়েই নমুনা দিচ্ছেন। বেশ কয়েকজন নারীকে দাঁড়িয়ে নমুনা দিতে দেখা গেল।

একটু দূরে ছোট ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা অপু। বাড়ি শহরের পালশা এলাকায়। ছেলে কাইফ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন করোনার নমুনা দিতে। কয়েক দিন জ্বরে ভুগছে ছেলেটা। তিনি জানান, গত ১৫ জুন করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে আইসোলেশনে ছিলেন। ৩ জুলাই নেগেটিভ এসেছে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া ছেলে কাইফ জ্বরে আক্রান্ত। তাই নমুনা দিতে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। ভিড় থেকে দূরে কেন, এমন প্রশ্নে জানান, নিজের টেস্ট করাতে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তাই আজ ১১টার দিকে এসেছেন।

এসব দৃশ্য দেখে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে। তার বলাবলি করছেন, হাসপাতালে কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. টি এম নুরুজ্জামান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে ২৪৭ জন করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে ক্রিটিকাল ৬ রোগীকে রাখা হয়েছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। হাসপাতালে এখন পর্যন্ত অক্সিজেনের কোনো সংকট হয়নি।

তিনি আরও বলেন, অক্সিজেন শেষ হওয়ার আগেই সরবরাহকারীরা অক্সিজেন সরবরাহ করছেন। হাসপাতালে আগের তুলনায় অক্সিজেন এখন বেশি ব্যবহার হচ্ছে করোনা রোগীদের সেবা দিতে। এখন দিনে প্রায় ২ হাজার ৫০০ লিটার অক্সিজেন ব্যবহার হচ্ছে।

হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংকট নিয়ে ডা. নুরুজ্জামান জানান, এখন আর সংকট নেই। ইতিমধ্যে ১৫টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা লাগানো হয়েছে। আরও ৪টি লাগানো হবে। ১৯টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার মধ্যে ১০টি এস আলম গ্রুপ, ৩টি ইট ভাটা মালিক সমিতি, ২টি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও ২টি বিএসআরএম কোম্পানি প্রদান করেছে এবং আগে থেকে হাসপাতালে ২টি সক্রিয় ছিল। হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা লাগানোর পর রোগীদের আরও বেশি সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

হাসপাতালে নমুনা বুথে না নিয়ে পেছনে নেওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, আজ নমুনা দেওয়ার লোকের সংখ্যা বেশি, তাই বুথে না নিয়ে পেছনে ফাঁকা স্থানে গ্রহণ করা হচ্ছে। তাই সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানা কষ্টের।

দুপুর ১২টায় হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় মেয়ের মরদেহ নিয়ে মা তাহেরা বেগমের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। জানা গেল, করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মুরশিদা বেগম (৪০)। বাড়িতে ছোট দুটি সন্তান রয়েছে। তাদের কী দিয়ে সান্ত্বনা দেবেন, এমনটা বলেই কান্না করছেন মা তাহেরা।

মুরশিদা বেগমের স্বামী ইদ্রিস আলী জানান, তারা জয়পুহাটের কালাই উপজেলার হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা। তিনি জানান, মুরশিদা কয়েক দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। জ্বর-সর্দির ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। গতকাল রাত থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সকালে প্রথমে কালাই হাসপাতালে সেখান থেকে আবার ক্ষেতলাল হাসপাতালে নিয়ে যান মুরশিদাকে। ক্ষেতলাল হাসপাতালের ডাক্তারের জানিয়েছেন, মুরশিদার করোনা হয়েছে। ওখানে চিকিৎসা বলে দিয়েছেন, সম্ভব নয়। তাকে বগুড়ায় নিয়ে আসতে বলেন।

বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে এসে স্ত্রী মুরশিদাকে ভর্তি করিয়ে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পরপরই তার মৃত্যু হয়। এখন আবার স্ত্রীর নিথর দেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ির পথে রওনা হলেন তিনি।

এনএ