সোমবার (০৫ জুলাই) সকাল ১০টা ৫২ মিনিট। খুলনা ১৩০ শয্যা বিশিষ্ট করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের সামনের সড়কে এসে দাঁড়াল একটি ইজিবাইক। ইজিবাইকে বসেই সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন নিচ্ছিলেন অর্পিতা নামে এক কলেজছাত্রী। তিনি জ্বর, গায়ে ব্যথা এবং তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছেন ১৩ দিন ধরে। অক্সিজেন সিলিন্ডার ধরে তার পাশেই বসে ছিলেন বাবা ওয়াহিদ। কিছুক্ষণ পর এলেন তার বড় ভাই জসিম।

জসিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অর্পিতা আমার ছোট বোন। তার করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছি ২৯ জুন। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার কথা। কিন্তু আজ ৫ জুলাই, ৭ দিন হয়ে গেছে, এখনো আমরা রিপোর্ট হাতে পাইনি। আজকেও যোগাযোগ করলাম, তারা কবে রিপোর্ট দিতে পারবে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। আমরা তাকে বাড়িতে রেখেছি, হাসপাতালে জায়গা নেই বলে ভর্তি করতে পারছি না। আমরা বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরছি, তারা করোনার রিপোর্ট ছাড়া ভর্তি নিতে রাজি নয়। আজকে আবারও নমুনা দেব। তবে কবে রিপোর্ট পাব তা বলতে পারছি না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বোন তো আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, অক্সিজেন লেভেল কমে যাচ্ছে, বুকে ব্যথা হচ্ছে, বমি হচ্ছে। এখানে ডাক্তাররা বলছেন, বেড নেই, ভর্তি রাখা যাবে না। মাঝে মধ্যে ওষুধ লিখে দিচ্ছেন, তবে তেমন কাজ হচ্ছে না। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম, করোনার রিপোর্ট ছাড়া সেখানকার ডাক্তার রোগী দেখতে চাচ্ছেন না। আবু নাসের হাসপাতালে নতুন একটা ইউনিট চালু হয়েছে। সেখানে গেলাম, তারাও বলছে, রিপোর্ট ছাড়া ভর্তি নেবে না। কোথাও চিকিৎসা পাইনি।’ 

এদিকে খুলনা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটের অভিযোগ করেছেন সাতক্ষীরা থেকে করোনা আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে আসা শহিদুল্লাহ শেখ। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা করোনায় আক্রান্ত হলে গত ২২ জুন তাকে এখানে ভর্তি করি। প্রথমদিকে সব ঠিকই ছিল, তবে ইদানীং অক্সিজেনের সংকট দেখা দিয়েছে। সময়মতো অক্সিজেন পাই না। ফ্লোরে পা রাখার মতো জায়গা নেই, মানুষ গিজগিজ করছে। নার্সদের ডাকলেও তারা আসতে আসতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। এজন্য আমার বাবাকে এখান থেকে আবু নাসের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’ 

এদিন সকাল থেকেই হাসপাতালের সামনে নমুনা দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় অনেককে। সেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীও নমুনা দিতে এসেছেন। আবার জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে অনেকেই প্রথমবার এসেছেন নমুনা পরীক্ষার জন্য। এই জায়গায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে না। এখান থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে, আশংকা করছেন অনেকে। 

খালিশপুর দুর্বার সংঘ এলাকা থেকে নমুনা পরীক্ষা করতে আসা মো. জুয়েল হোসেন বলেন, গত ২৫ জুন আমার করোনা পজিটিভ হয়। শরীর কিছুটা সুস্থ মনে হওয়ায় করোনা পজিটিভ নাকি নেগেটিভ সেটি জানার জন্য নমুনা দিতে এসেছি। 

তিনি বলেন, অনেকেই নমুনা পরীক্ষা করতে এসেছেন। তারা হয়তো নেগেটিভ কিন্তু আমার পজিটিভ। এভাবে সংস্পর্শে আসলে করোনা সংক্রমণ দ্রুত ছড়াতে পারে।

উপসর্গ নেই, তবুও নমুনা পরীক্ষা করাতে এসেছেন খালিশপুর নেভিগেট এলাকার বাসিন্দা আমিরুন্নেসা। তিনি বলেন, আমার ছেলে ইমরানের করোনা পজিটিভ ছিল। তার ১৪ দিন হয়ে গেছে। তার সঙ্গে আমিও এসেছি। যেহেতু একই বাড়িতে থাকি সেজন্য আমারও নমুনা টেস্ট করাব। 

তিনি বলেন, আমার শরীরে কোনো উপসর্গ নেই। তবে আগে থেকে শ্বাসকষ্ট রয়েছে। 

শুধু অর্পিতা, শহিদুল্লাহ, জুয়েল ও আমিরুন্নেসা নয়, হাসপাতালে সেবা নিতে এসেছেন এমন অসংখ্যা মানুষ। তাদের কেউ কেউ নিজেরাই রোগী, আবার কেউ কেউ রোগীর স্বজন। কাউন্টারের পাশেই নাম ডাকার অপেক্ষায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। একজনের নাম ডাকা হলেই সবাই এক রকম হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন কাউন্টারের সামনে। 

খুলনা ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালের ফোকাল পারসন ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার জানান, ১৩০ শয্যার হাসপাতালে সকাল ৮টা পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন ১৮৭ জন। যার মধ্যে রেডজোনে ১১৭ জন আর ইয়োলো জোনে ৩০ জন ভর্তি ছিলেন। এছাড়া আইসিইউ শয্যা খালি নেই। আইসিইউর ২০টি শয্যাই রোগীতে পরিপূর্ণ। আর এইচডিসিতেও ২০ জন রয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ৩৬ জন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪৫ জন।

তিনি বলেন, নমুনা সংগ্রহের স্থানে মানুষকে দূরত্ব মেনে চলার কথা বলা হলেও কেউ সেটা মানছেন না। এ কারণে একটু জটলার সৃষ্ট হচ্ছে।

ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, আইইডিসিআরের রিপোর্ট অনুযায়ী গত জুনে যতগুলো করোনা আক্রান্ত রোগীর র‌্যানডম স্যাম্পলিং হয়েছে তার ৭৮ শতাংশই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এ কারণে মানুষ অনেকটা ভয় পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। যে কারণে রোগীর চাপ বেড়েছে।

তিনি বলেন, কখনো কখনো রোগীরা অভিযোগ করতে পারেন অক্সিজেন পাননি। তবে হাসপাতালে অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই। এখানে আরও একটি লিকুইড অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। সেটার কার্যক্রম দু-একদিনের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে। 

ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে রোগীর চাপ থাকায় ফ্লোরেও রোগী রাখতে হচ্ছে। আবু নাসের হাসপাতালে হয়তো সুযোগ-সুবিধা বেশি, তাই কেউ কেউ রোগী নিয়ে সেখানে গেছে। আমাদের এখানে অক্সিজেনের কোনো অভাব নেই।

খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মেহেদী নেওয়াজ জানান, ভেতরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় গত সপ্তাহের বুধবার (২৯ জুন) থেকে খুলনা মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা বন্ধ ছিল। ভাইরাসমুক্ত করে রোববার (০৪ জুন) বিকেলে ল্যাবটি আবার সচল করা সম্ভব হয়েছে। এদিন সীমিত পরিসরে ৭৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৫৭ জনের করোনা পজিটিভ এসেছে। এই নমুনাগুলো খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও খুলনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি থাকা করোনা রোগীদের। আজ সোমবার থেকে ল্যাবে পুরোদমে নমুনা পরীক্ষা শুরু হয়েছে।  

আরএআর/জেএস